মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১

অভিশপ্ত কবিরা -- ভেরলেন, র‌্যাঁবো, মালার্মে, করবিয়ের প্রমুখ

 

অভিশপ্ত কবিরা - ভেরলেন, রেঁবো, মালার্মে, করবিয়ের প্রমুখ : মলয় রায়চৌধুরী

  ‘পোয়েত মদি’ ( Poète maudit ) বা ‘অভিশপ্ত কবি’ নামে ১৮৮৪ সালে ফরাসি প্রতীকবাদী ও ‘ডেকাডেন্ট’  কবি পল ভেরলেন একটি বই প্রকাশ করেছিলেন । অভিধাটি ১৮৩২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন অ্যালফ্রেদ দ্য ভিনি ( Alfred de Vigny ) তাঁর  ‘স্তেলো’ উপন্যাসে ; তিনি বলেছিলেন ‘পোয়েত মদি’ হিসাবে চিহ্ণিত লোকগুলোকে জগতের ক্ষমতাধর মানুষেরা চিরকাল অভিশাপ দেবে।  ত্রিস্তঁ করবিয়ের (Tristan Corbière ) , জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালার্মে, মারসেলিঁ দেবোর্দে-ভামো ( Marceline Desbordes-Valmore ) এবং আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে  আদঁকে ( Auguste Villiers de l'Isle-Adam ) পল ভেরলেন চিহ্ণিত করেছিলেন অভিশপ্ত কবি হিসাবে । এই তালিকায় তিনি নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পুভ লেলিয়ান ( Pauvre Lélian ) ছদ্মনামে । উল্লেখ্য যে ১৮৮৪ সালে স্ত্রী মাতিলদে ভেরলেনকে আইনত ডিভোর্স করেছিলেন ।

          পল ভেরলেন তাঁকে ‘অভিশপ্ত কবি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ত্রিস্তঁ করবিয়ের ( ১৮৪৫ - ১৮৭৫ ) ফরাসি আলোচকদের কাছে সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিলেন ; বহুকাল পরে এজরা পাউণ্ড ও টি. এস. এলিয়ট তাঁর কবিতা বিশ্লেষণের পর ত্রিস্তঁ করবিয়েরকে কাব্যসাহিত্যে গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ হয় । করবিয়েরের মা, মারি-অঞ্জেলিক-আসপাসি পুয়ো’র বয়স যখন উনিশ তখন করবিয়েরের জন্ম হয় । তাঁর বাবা আঁতোয়াঁ-এদুয়া করবিয়ের ‘লে নেগরিয়ের’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন । রাজকীয় উচ্চবিদ্যালয়ে ১৮৫৮ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত পড়ার সময়ে তিনি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন এবং রিউমেটিজমের কারণে হাত-পা বিকৃত হয়ে যায় । বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্কুলে দেবার এবং শারীরিক বিকৃতির দরুন তিনি বাবা-মাকে দোষ দিতেন । স্কুলের কড়া নিয়মনীতি ও শিক্ষদের প্রতি ঘৃণা তাঁর কবিতায় একটি বিশেষ কন্ঠস্বর গড়ে দিতে পেরেছে।করবিয়ের মারা যান যক্ষ্মারোগে, মাত্র তিরিশ বছর বয়সে । করবিয়েরের একটি কবিতা :

বিপরীত কবি

আরমোরিকার সাগরতীরে । একটি নির্জন মঠ ।

ভেতরে : বাতাস অভিযোগ করছিল : আরেকটা হাওয়াকল ।

এলাকার সমস্ত গাধা বীজসুদ্ধ আইভিলতায় তাদের দাঁত ঘষতে এসেছিল

ফুটোয় ভরা এমনই এক দেয়াল থেকে যা কোনও জীবন্ত মানুষ

দরোজার ভেতর দিয়ে ঢোকেনি।

 

একা— তবু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, ভরসাম্য বজায় রেখে,

একজন বুড়ির থুতনির মতন ঢেউখেলানো

তার ছাদ কানের পাশে চোট দিয়েছিল,

হাবাগবা মানুযের মতন হাঁ করে, মিনারটা দাঁড়িয়েছিল ।

          অভিশপ্ত কবি জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর ( ১৮৫৪ - ১৮৯১ ) কবিতার সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত ; তাঁর ‘ইল্যুমিনেশানস’ বইটির নামকরণ করেছিলেন পল ভেরলেন । বইটি থেকে ‘শহর’ শিরোনামের গদ্যকবিতা :

এক মহানগর যাকে এই জন্যে আধুনিক মনে করা হয় যে বাড়িগুলোর বাইরের দিক সাজানোয় আর নগরের পরিকল্পনায় প্রয়োগ করার জন্য পরিচিত উপলব্ধিগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ; তারই  আমি এক ক্ষণজীবী আর তেমন বিচ্ছিন্ন নাগরিক নই । এখানে তুমি কুসংস্কারের একটিও স্মৃতিস্তম্ভের হদিশ পাবে না । সংক্ষেপে, নৈতিকতা আর ভাষাকে সরলতম প্রকাশে নামিয়ে আনা হয়েছে ! লক্ষাধিক এই লোকজন যারা পরস্পরকে জানার প্রয়োজন অনুভব করে না, নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, কর্মকাণ্ড, বার্ধক্যে এতো মিল যে  তাদের আয়ু  মহাদেশের গোলমেলে সংখ্যাতত্ব যা বলেছে তার চেয়েও বেশ  কম । তাই, আমার জানালা দিয়ে, দেখতে পাই নতুন প্রেতরা শাশ্বত ঘন ধোঁয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে --- আমাদের বনানীঘেরা ছায়া, আমাদের গ্রীষ্মের রাত ! -- প্রতিহিংসর নতুন গ্রিক দেবতারা, আমার কুটিরের সামনে, যা আমার স্বদেশ, আমার সমগ্র হৃদয়, কেননা এখানে সবকিছুরই পরস্পরের সঙ্গে মিল আছে -- ক্রন্দনহীন মৃত্যু, আমাদের সক্রিয় কন্যা আর চাকরানি, রাস্তার কাদায় বেপরোয়া ভালোবাসা আর ফালতু অপরাধ ফুঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ।  

 স্তেফান মালার্মে ( ১৮৪২ - ১৮৯৮ )  বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ কবিতাটির টাইপসেটিং সাজানোর ও সেকারণে মর্মার্থের বহুত্বের জন্য পরিচিত হলেও, বর্তমানে খুব বেশি পঠিত নন । বলা যায় যে ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ ইউরোপের কবিতার ধারায় বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল; ঘুটির চাল ডিগবাজি খেতে-খেতে এঁকে বেঁকে যেভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেইভাবে পঙক্তিগুলো সাজিয়েছিলেন মালার্মে ।কবিতার মধ্যে সহজাত শুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতা আনার প্রচেষ্টায়  ভাষাগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে না পেরে তিনি প্রায়ই উদ্ভাবনী শব্দ বিন্যাস, জটিল উপমা ও পরীক্ষামূলক মুদ্রণবিদ্যা প্রয়োগ করে কবিতা লিখে পাঠকের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মালার্মের সাহিত্য চর্চায় সারা জীবনের গোঁ ছিল যে, পাঠকরা প্রতীকের অর্থ বুঝুক । সাহিত্য ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক তুষ্টিকে তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন । তাঁর বাড়িতে প্রতি মঙ্গলবার সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো, কিন্তু স্কুলে শিক্ষকতা করার দরুণ তাঁর আর্থিক অবস্হা কোনো দিনই ভালো ছিল না ।স্বাভাবিক যে পাঠকদের মনে হয়েছে তাঁর কবিতার ভেতরে ঢোকা যায় না । এখানে তাঁর ‘কবিতার আবির্ভাব’-এর বাংলায়ন দিচ্ছি

দু:খি হয়ে পড়ছিল চাঁদ। কাঁদুনে দেবশিশুরা স্বপ্ন দেখছিল।

শান্ত ও বাষ্পীয় ফুলের তোড়ায় তাদের তীরবাহী আঙুল

যেন তাদের মরণাপন্ন বেহালার তার বাজছিল

আর আকাশ-নীল ফুলের পাপড়িতে গড়িয়ে পড়ছিল স্বচ্ছ অশ্রু।

সে ছিল তোমার প্রথম চুমুর আশীর্বাদ-পাওয়া দিন,

আর আমি  আমার স্বপ্নের কাছে শহিদ হলুম,

যা বিষাদের সুগন্ধীর উপর ভর করে বেঁচেছিল,

এমনকি কোনও পরিতাপ বা দূর্ঘটনা ছাড়াই

একটি স্বপ্নকে সেই হৃদয়ের কাছে রেখে গিয়েছে

যে প্রথম স্বপ্নটি তুলেছিল।

এখানে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম, পাথরে বাঁধানো রাস্তায়

আমার চোখ নাচছিল।

যখন তুমি চুলে সূর্যের উচ্ছাস নিয়ে, রাস্তায় আর রাতের বেলায়

হাসিমুখে  আমার কাছে এসেছো,

আর আমি ভাবলুম  আলোর টুপি পরা এক পরীকে দেখছি,

যে আমার ছোটোবেলাকার ঘুমে স্বপ্নে দেখা দিত,

আর  যার আধখোলা-মুঠো থেকে

সুগন্ধী নক্ষত্রের দলে ঝরে পড়তো  তুষারপুঞ্জ

গাছেদের সরু ডালে ।

         মহিলা কবি মার্সেলিন দেবোর্দে-ভামো’’র ( ১৭৮৬ - ১৮৪৯ ) জন্ম রনেঁর দুয়া তে। ফরাসি বিপ্লবের কারণে তাঁর বাবার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায় এবং আর্থিক সাহায্যের জন্য মায়ের সঙ্গে গুয়াদালুপ চলে যান; সেখানে তাঁর মা জনডিসে মারা যান আর ষোলো বছর বয়সী মারসেলিঁকে প্যারিসে ফিরে নাটকের দলে যোগ দিয়ে রোজগারের পথ বেছে নিতে হয় । ১৮১৭ সালে নাটকদলের একজন মামুলি অভিনেতা প্রসপার লাশান্তাঁ-ভামোকে বিয়ে করেন । ১৮১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্হ ‘এলেজি এবং রোমান্স’ । ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ক্রীতদাসদের নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘অ্যান্টিলেসের সন্ধ্যা’ । তাঁর ‘উদ্বেগ’ কবিতার বাংলায়ন দিচ্ছি এখানে ; ওনার নাম বাঙালি পাঠক শুনেছেন বলে মনে হয় না ; বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি সত্যিই অভিশপ্ত :

কি যে আমাকে বিপর্যস্ত করে ? কেনই বা অপেক্ষা করব ?

এই শহরে, বড়ো বেশি বিষাদ ; তা থেকে, প্রচুর অবসর ।

আধুনিক সুখানুভব নামে যা চলছে

প্রতি ঘণ্টার পেষাই থেকে আমাকে সুরক্ষিত করতে পারে না ।

একসময়ে বন্ধুত্ব ছিল, কোনো বইয়ের আকর্ষণ

চেষ্টা ছাড়াই ভরে তুলতো অতিরিক্ত সময় ।

ওহ এই অস্পষ্ট আকাঙ্খার উদ্দেশ্য কি ?

আমি তা এড়িয়ে যাই, কিন্তু উদ্বেগ আমাকে ফিরে দেখতে বলে ।

আনন্দ যদি আমার হর্ষে ধরা না দ্যায়

তাহলে আমি তাকে দুঃখের বিশ্রামেও পাবো না,

তাহলে কোথায়ই বা পাওয়া যায় আমোদপ্রমোদ ?

আর তুমি যে আমাকে যা চাইছি তা দিতে পারো,

তুমি কি আমাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে যাবার নির্ণয় নিয়েছ ?

আমাকে বলো, যুক্তিতর্ক, অনিশ্চিত, বিভ্রান্তিকর,

তুমি কি প্রেমের ক্ষমতাকে  অনুমতি দেবে আমায় দখল করতে ?

হায়, নামটা শুনলেই আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে !

কিন্তু যে ভয় উদ্বুদ্ধ করে তা অমায়িক আর সত্যি ।

যুক্তিতর্ক, তোমার কাছে ফাঁস করার মতন আর কোনো গোপনীয়তা নেই,

আর আমি ভাবি এই নামটি তোমার চেয়ে তাদের কথা বেশি বলেছে ! 

          এবার জানা যাক আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে আদঁ-র ( ১৮৩৮ -৮৯ ) কথা । ব্রিট্যানির এক অভিজাত পরিবারে জন্ম, যদিও তাঁদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না আর নির্ভর করতে হতো মায়ের কাকিমা মাদামোয়াজেল দ্য কেরিনুর দান-খয়রাতের ওপর । তার ওপর ভিলিয়ার্সের বাবার গোঁ চাপে যে তিনি মালটায় গিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে লুকোনো গুপ্তধন উদ্ধার করবেন । ফলে তিনি জমি কিনতেন আর গুপ্তধন না পেয়ে বেচতেন । এই করে ফতুর হয়ে যান । ভিলিয়ার্সকেও ডজনখানেক স্কুল পালটাতে হয় । ১৮৫০ এর পর তিনি বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়ে কাজের খোঁজ করে কিছুই যোগাড় করতে পারেননি । পাকাপাকি প্যারিসে থাকার ব্যবস্হার জন্য তাঁর এক আত্মীয়া মাসিক খরচের ব্যবস্হা করেন । তিনি ল্যাটিন কোয়ার্টারের মদ্যপ কবি-লেখকদের আড্ডায় যোগ দ্যান এবং শার্ল বোদলেয়ারের পরামর্শে এডগার অ্যালান পোর রচনাবলী পড়া আরম্ভ করেন । ১৮৫৯ সালে নিজের টাকায় প্রকাশ করেন ‘প্রথম কবিতাবলী’ । বইটা কোথাও আলোচিত হলো না । উপরন্তু তিনি লুইজি দায়োনে নামে এক বহুবল্লভা যুবতীর সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করলেন ; তাঁর পরিবারে সদস্যদের চাপে ১৮৬৪ সালে যুবতীটিকে ছেড়ে গীর্জায় আশ্রয় নিতে হয় । ভিলিয়ার্স অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করার মতন যুবতী পাচ্ছিলেন না ; তিনি থিয়োফিল গতিয়েকে তাঁর মেয়ে এসতেলে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে গতিয়ের তাঁকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেন যে তিনি ভবঘুরে মাতাল অখ্যাত কবির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না । অ্যানা আয়ার পাওয়েল নামে বৈভবশালী ইংরাজ যুবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হন । শেষে তিনি এক বেলজিয় ঘোড়ার গাড়ির চালকের অশিক্ষিতা বিধবা স্ত্রী মারি দানতিনের সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করেন আর ১৮৮১ সালে তাঁর ছেলে ভিক্তরের জন্ম হয় । কিন্তু কবিস্বীকৃতি, ভেরলেনের বইতে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে, তিনি পাননি । এখানে ভিলিয়ার্সের  ‘স্বীকৃতি’ কবিতাটির বাংলায়ন :

যবে থেকে আমি শব্দগুলো ভুলে গেছি, যৌবনের

ফুল আর এপ্রিলের টাটকা বাতাস…

আমাকে তোমার ঠোঁট দুটি দাও ; তাদের সুগন্ধি যৌতুক

গাছেদের ফিসফিস কথাবার্তা হয়ে দেখা দেবে !


যবে থেকে আমি গভীর সমুদ্রের দুঃখ হারিয়েছি

মেয়েটির কান্না, তার অস্হির টান, তার মৃত্যুর আলয়…

একটা শব্দেরও শ্বাস ফেলে না ; তা বিষাদ বা আনন্দ

হয়ে উঠবে ঢেউদের কলকল-ধ্বনি !


যবে থেকে আমার আত্মায় অন্ধকারের ফুল

আত্মমগ্ন, আর পুরোনো সূর্ষেরা উড়াল নেয়…

প্রিয়তমা আমাকে তোমার মলিন বুকে লুকিয়ে নাও,

আর তা হয়ে উঠবে রাতের প্রশান্তি !


          কিন্তু অভিশপ্ত কবিদের তালিকায়  তাঁর গুরু শার্ল বোদলেয়ার, কোঁতেদ্য লুতিয়ামোঁ (Comte de Lautréamont ) , অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( Alice de Chambrier ), আঁতোনা আতো ( Antonin Artaud ), জঁ-ফিয়ে দ্যুফে ( Jean-Pierre Duprey )  প্রমুখকে যোগ করেন পরবর্তীকালের আলোচকরা ; বস্তুত পল ভেরলেনই ছিলেন সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত। এই কবিরা তাঁদের কবিতার জন্য অভিশপ্ত নন ;  তাঁদের জীবনের দুঃখ, বিষাদ, আর্থিক দৈন্য, পরাজয়বোধ, অবহেলা, মাদকে আসক্তি, যৌনরোগ ইত্যাদির কারণে তাঁদের মনে করা হয়েছে ‘অভিশপ্ত’। তাঁর মৃত্যুর পর Fin de siècle বা শতাব্দী শেষের কবিদের অন্যতম মনে করে হয় পল ভেরলেনকে। 

        প্রথমে পড়া যাক শার্ল বোদলেয়ারের গদ্য কবিতার বই ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ এর একটি রচনা : 

আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।

আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে -- যাকিছু আমি অনুভব করি -- তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে।তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।

তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।

তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।

আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।

আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।

          কঁতে দ্য লুতিয়ামোর ( ১৮৪৬ - ১৮৭০ ) প্রকৃত নাম ইসিদোরে লুসিয়েন দুকাস, জন্মেছিলেন উরুগুয়েতে । তাঁর জন্মের পরেই মা মারা যান ; তখন আর্জেনটিনা আর উরুগুয়ের যুদ্ধ চলছে । তাঁর বাবা, যিনি ফরাসিভাষী ছিলেন, তাঁকে তেরো বছর বয়সে প্যারিসে পাঠিয়ে দ্যান স্কুল শিক্ষার জন্য । সতেরো বছর বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দাঁতে, মিলটন, বোদলেয়ার এবং রাসিনে মুখস্হ বলতে পারতেন বলে শিক্ষকদের প্রিয় ছিলেন । কিন্তু নির্ণয় নেন যে তিনি নিজে ‘নিষ্ঠুরতার আনন্দবোধ’ নিয়ে কবিতা লিখবেন । ‘মালদোরোরের গান’ নামে তিনি একটি কাব্যোপন্যাস লেখেন, ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সালের মাঝে,  তাঁর এই নির্ণয়কে রূপ দেবার জন্য । নায়কের নাম মালদোরোর । বইটি ছয় পর্বে আর ষাটটি কবিতাংশে বিভাজিত । ডাডাবাদীরা, পরাবাস্তববাদীরা, বিশেষ করে সালভাদোর দালি,  তাঁর এই বইটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বইটির বহু দৃশ্যের এচিং করেছিলেন দালি । আমি বইটি থেকে একটি কবিতাংশ তুলে দিচ্ছি:

আমি নোংরা । আমার সারা শরীরে উকুন । শুয়োররা, যখন আমার দিকে তাকায়, বমি করে। আমার চামড়া কুষ্ঠরোগের মামড়ি আর আঁশে ছয়লাপ, আর তার ওপরে হলুদ রঙের পুঁজ । আমার বাঁদিকের বগলে এক ব্যাঙ পরিবার বসবাস আরম্ভ করেছে, আর, তাদের কোনো একটা নড়াচড়া করলে, কাতুকুতু দ্যায় । মনে রাখতে হয় যাতে বাইরে বেরিয়ে মুখ দিয়ে কান আঁচড়াতে না আরম্ভ করে ; তাহলে সেটা মগজে ঢুকে যাবে । আমার ডানদিকের বগলে রয়েছে একটা গিরগিটি যে সব সময়ে ওদের তাড়া করে যাতে খাবার না জোটায় মারা যায় : সবাইকে তো বাঁচতে হবে । আমার পোঁদের ভেতরে একটা কাঁকড়া ঢুকে গেছে ; আমার কুঁড়েমিতে উৎসাহিত হয়ে, ঢোকার পথটা নিজের দাড়া দিয়ে পাহারা দ্যায় আর আমাকে দ্যায় অসহ্য যন্ত্রণা ।

অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( ১৮৬১ - ১৮৮২ ) একুশ বছর বয়সে কোমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তার কিছুকাল আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘ঘুমন্ত সুন্দরী’ । তাঁর অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর । এখানে তাঁর ‘পলাতক’ কবিতাটির বাংলায়ন :

আমরা সবাই আগন্তুক আর পৃথিবী হয়ে চলে যাই

খেলার সময়ে উধাও আলোর নৌকোর মতো

হালকা হাওয়ায় চুপিচুপি চুমুর আড়ালে,

আর নীল দিগন্ত ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় ;


উড়ালের সময়ে যদি হলরেখার খাত গড়তে পারে তাহলে আনন্দিত

সে চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ;

যে পথ সে দ্রুত যাত্রায় খুঁজতে চেয়েছিল

 কোনো ঘুর্ণিঝড় তাকে মুছে দিতে  পারে না;


আনন্দিত, যদি অদৃষ্ট আমাদের টেনে বের করে আনে

আমরা তবুও হৃদয় হয়ে বাঁচি যেখানে থেকেছি চিরকাল,

সুদূর সমুদ্রতীর পর্যন্ত যে হৃদয় আমাদের অনুসরণ করে

তাহলে এখানে এক মৃত মানুষের সমাধিকে কী বলা হবে ?

          আঁতোনা জোসেফ মারি আতো ( ১৮৯৬ - ১৯৪৮ ), যিনি আঁতোনা আতো নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, নাট্য পরিচালক এবং ইউরোপীয় আভাঁগার্দ আন্দোলনের পুরুষদের অন্যতম । ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ তত্বটির জন্য তিনি অধিকতর পরিচিত । যদিও তাঁর জন্ম ফ্রান্সের মার্সাইতে, তাঁর বাবা-মা ছিলেন গ্রিক । জাহাজের মালিক ছিলেন তাঁর বাবা । তাঁর মায়ের নয়টি বাচ্চা হয়েছিল, চারটি মৃত অবস্হায় জন্মায় আর দুটি শৈশবেই মারা যায় । পাঁচ বছর বয়সে আতো আক্রান্ত হন মেনেনজাইটিসে, যার দরুন কোমাটোজে ছিলেন কিছুকাল এবং বিভিন্ন স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসার জন্য পাঁচ বছর ভর্তি ছিলেন । ১৯১৬ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে হয়েছিল কিন্তু মানসিক অস্হিরতার কারণে ছাঁটাই হন । দীর্ঘ রোগভোগের দরুণ তাঁকে ল্যডানডাম ওষুধ ( অ্যালকোহলে গোলা আফিম ) নিতে হতো আর সেখান থেকেই তাঁর আফিমের নেশা ।সাতাশ বছর বয়সে তিনি এক গোছা কবিতা ‘নতুন ফরাসি রিভিউ’ ( Nouvelle Revue Française ) পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠান ; তা প্রত্যাখ্যাত হলেও সম্পাদক তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে চিঠি লেখেন এবং বেশ কিছু সময় তাঁদের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান হয় । এখানে তাঁর কয়েকটা কবিতার বাংলায়ন দিলুম, কেননা তাঁর কবিতার বই সহজে পাওয়া যায় না :                               

নিরংশু কবি

নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক

তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,

তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে

আর জীবন পুড়তে থাকে,

আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,

জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।

 

অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত

অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;

ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।

 

চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে

আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়

মায়ের নীল দুধের মতন ;

নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,

তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।

 

আমার টাকাকড়ি নেই

আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু

আমি

আঁতোনা আতো

আর আমি ধনী হতে পারি

ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি

যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।

সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,

ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।

 

কালো বাগান

এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।

ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।

তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।

আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,

চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে

আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।

 

আমি কে

আমি কে ?

আমি কোথা থেকে এসেছি ?

আমি আঁতোনা আতো

আর আমি একথা বলছি

কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়

তাৎক্ষণিকভাবে

তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে

ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে

আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে

দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে

এক নতুন শরীর

তখন তুমি আমাকে

কখনও ভুলতে পারবে না ।

 

স্নায়ু ছন্দ

একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।

মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।

সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।

আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,

আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।

আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।

যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,

এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,

বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা

ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে

যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে

শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),

আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,

স্হবিরতা, শীতলতা–

সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল

আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,

যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,

আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি

তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।

ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।

ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,

অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।

মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,

আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,

বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে

আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা

তার ওপর কাজ করে চলেছে ।

বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।

বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।

চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।

এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।

ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।

আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।

আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।

আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।

          ১৯৫০ সালে, কুড়ি বছর বয়সে, জাঁ ফিয়ে দুফের (১৯৩০ - ১৯৫৯ ) প্রথম কবিতার বই ‘দ্বিতীয়ের পেছনে’র পাণ্ডুলিপি পড়ে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন । এক বছর পরে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে ভাস্কর্যে আগ্রহী হন, আর পাঁচের দশকের পুরো সময় লোহা আর সিমেন্টের কাজ করেন, সেই সঙ্গে চারকোল ও কালির কাজও করেন । ১৯৫৯ সালে ব্যক্তিগত দ্রোহ প্রকাশ করার জন্য আর্ক দ্য ত্রয়েম্ফে অজানা সেনাদের শিখায় পেচ্ছাপ করার সময়ে ধরা পড়েন আর জনগণের পিটুনি খেয়ে প্রথমে কারাগারে আর তারপর পাগলাগারদে যেতে হয় । ছাড়া পেয়ে আবার কবিতা লেখা আরম্ভ করেন এবং ‘শেষ ও উপায়’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি স্ত্রীর হাতে দিয়ে নির্দেশ দ্যান তা ব্রেতঁকে ডাকে পাঠিয়ে দিতে । বাড়ি ফিরে স্ত্রী জ্যাকলাঁ দেখতে পান যে ছবি আঁকার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে জাঁ ফিয়ে দুফে আত্মহত্যা করেছেন । কাব্যগ্রন্হটি থেকে ‘সম্পূর্ণ’ শিরোনামের গদ্য কবিতাটির বাংলায়ন :

         জগতসংসার সম্পূর্ণ । কে সেই লোক যে রাতকে প্রতিবার একই ফাঁদে ফ্যালে ? আমি, যদি বলা হয়, কাউকেই চিনি না আর যে আকাশ আমার ওপর মনের ঝাল মেটায়, ওর বড়ো ইঁদুরের হাত আমাকে কখনও, কখনও দেখায়নি ।

          কেউ একজন দরোজাটা খুললো : ভেতরে ছিল না কেউ, ভেতরে তার ছিল হাড় আর হাড়, আর আমি প্রতিজ্ঞা করে সবাইকে জানিয়েছি যে আমি জ্যান্ত ওর চামড়া ছাড়িয়ে নেবো ।

         জগতসংসার ভয়ঙ্করভাবে সম্পূর্ণ ছিল আর জিনিসপত্রের টানাটানি চলছিল । কেউ একজন দুঃস্বপ্নকে সাজিয়ে রাক্ষসদের আলোকিত করছিল আর তাকে বলা হচ্ছিল বর্তমান, এখন…

         এই বর্তমানগুলো আমাদের বহু সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছিল, আমি থেকে আমিতে, আমার থেকে আমার সঙ্গে আর অন্য অনেকের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে অন্য অনেকের...কিন্তু অনেকসময়ে সবচেয়ে বিচক্ষণ ভাগাভাগিও আমাদের আলাদা করতে পারে, কিন্তু মাথা কখনও, আর আমি বলতে চাই কখনও, কাঁধের ওপরে স্হিতিশীল থাকেনি ।

দুই

          ‘অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবীদের’ কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে যে পল ভেরলেন চল্লিশ বছর বয়সে কয়েকজন কবিকে ‘অভিশপ্ত কবি’ চিহ্ণিত করে একটা বই লিখলেন কেন ? তিনি কি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, নাকি নিজেকে দেখতে চাইছিলেন সেই কবিদের সারিতে যাঁদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ কবি মনে করলেও তখনকার ‘বুর্জোয়া পাঠক’ কোনও পাত্তা দিতেন না । চল্লিশ বছর বয়সে র‌্যাঁবোকে খুনের চেষ্টার দায়ে জেল খেটে ফিরেছেন, একজনকে ( অনেকের মতে নিজের মা-কে ) মারধর করার কারণে আবার জেলে গিয়েছিলেন, রোমান ক্যাথলিক হিসাবে দীক্ষা নিয়েছেন, তবু তাঁর কেন মনে হয়েছিল তাঁর মতনই কয়েকজন কবি অভিশপ্ত ? সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁরা ছিলেন অখ্যাত, সমাজ তাঁদের প্রতি উদাসীন ছিল কেননা তাঁদের কবিতা তারা বুঝে উঠতে পারছিল না । কেবল রসপণ্ডিতরা তাঁদের কবিতায় আগ্রহী ছিলেন আর সেকারণে তাঁদের জীবন দুর্দশাপূর্ণ ছিল । উপেক্ষার, এমনকি ‘বুর্জোয়া অশিক্ষিতদের দ্বারা’ পদদলিত হবার চর্চিত বোধ, হয়তো ছিল প্রথম পর্বের আভাঁ গার্দ লেখক-কবিদের ধ্রুপদি দাবি।ফরাসিদেশের কবি-চিত্রকরদের মাঝে আত্মক্ষয়ের গৌরব প্রশংসনীয় ছিল তাঁদের নিজেদের গণ্ডিতে ।

         অভিশাপটি একই সঙ্গে যতোটা নৈতিক ও আত্মিক মনে করেছিলেন ভেরলেন, ততোটাই সামাজিক, যে মানসিকতা থেকে এই বোধের সূত্রপাত যে ‘সত্যকার শিল্পীকে’ প্রতিভার চাপ সহ্য করে ক্লেশ ও নিদারুণ-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় । চল্লিশ বছর বয়সে ভেরলেন মাতলামি, স্ত্রী ও মাকে মারধর করে, বাচ্চাকে যাতনা দিয়ে, সিফিলিসে ভুগে, বস্তিতে জীবন কাটিয়ে, ভিক্ষাবৃত্তি করে, জীবনের মর্মভেদী যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে অতিপরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং কবিদের ক্ষেত্রে ‘অভিশাপ’ যে কেবল সমাজের দেয়া নয়, তাঁরা নিজেরাও এমন সমস্ত কাজকর্ম করেছেন যে প্রকৃতি তাঁদের জীবনে বিপদ ডেকে এনেছে, তাঁদের দেহ ও অন্তরজগতকে ক্ষইয়ে দিয়েছে, তা টের পেয়েছিলেন তিনি ।

          পল ভেরলেনের কাছে ‘অভিশপ্ত কবির’ প্রধান দৃষ্টান্ত ছিলেন শার্ল বোদলেয়ার ( ১৮২১ - ১৮৬৭ ) যাঁর ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ), ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত, ছিল উনিশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্হ এবং পৃথিবীর সাহিত্যে অতুলনীয় । বইটির কবিতাগুলোয় ছিল সৌন্দর্যের সঙ্গে ইতরতার বৈপ্লবিক মিশ্রণ, তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল  চরম আধ্যাত্মিকতা যার জন্য আধুনিক যুগ বহুকাল অপেক্ষা করছিল, যা একই সঙ্গে ছিল স্বর্গে ঝড়-তোলা ও নাছোড়বান্দাভাবে  নারকীয় । মর্ত্যে নরকভোগের অভিজ্ঞতা শার্ল বোদলেয়ারের ছিল, এবং তার অধিকাংশ তাঁর নিজের গড়া নরক । লাতিন কোয়ার্টার থেকে তুলে এনেছিলেন এক শ্যামলী বেশ্যাকে, আর তার থেকে প্রেমের পাশাপাশি পেয়েছিলেন সিফিলিস । তেত্রিশ বছর বয়সে মাকে বোদলেয়ার লিখেছিলেন, “আমি প্রথম থেকেই জঘন্য।” অথচ উত্তরাধিকারসূত্রে যা টাকাকড়ি পেয়েছিলেন, তিনি সারাজীবন আরামে জীবন কাটাতে পারতেন । আঁতোনা আতোর মতন বোদলেয়ারও লডানডাম ( মদে মেশানো আফিম ) মাদকের নেশা ছাড়তে পারেননি । যে লোক নিজেকে অভিশপ্ত মনে করে, সে তার কারণ খোঁজে । বোদলেয়ারে পাওয়া যায় যিশুখ্রিস্টের উপহাস । ‘সেইন্ট পিটারের অস্বীকৃতি’ কবিতায় বোদলেয়ার বলছেন:

আহ ! যিশু, অলিভের বাগানকে মনে করো !

তোমার সারল্যে তুমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছিলে তার কাছে

যে স্বর্গে রয়েছে সে হাসছিল পেরেকের শব্দে

যেগুলো নীচ জল্লাদেরা তোমার মাংসে পুঁতে দিচ্ছিল ।

          বিশোধক যন্ত্রণাবোধের ধারণাকে বোদলেয়ার দিয়েছেন এক বিশেষ উতরাই, যা টেনেছিল পল ভেরলেনকে । ভেরলেন জানতেন যে বোদলেয়ারের নায়ক ছিলেন এডগার অ্যালান পো, যিনি, বোদলেয়ারের মতে, অত্যধিক মদ খাবার কারণে মারা যান, ‘অভিশপ্ত কবি’র সৃষ্টিক্ষমতা ও আত্মধ্বংসের ক্ষমতা দুটিই ছিল অ্যালান পোর অহংকার । বোদলেয়ারের চরস আর আফিমের নেশা ছিল যা তিনি ক্ষতিকর মনে করেও ছাড়তে পারেননি ; ‘অভিশপ্ত কবির’ যদি মনে হয় মাদক তাঁর চেতনাকে উন্নীত করছে, তাহলে তার ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিভার দাম চোকানো হিসেবে তিনি মান্যতা দেবেন । এডগার অ্যালান পো, শার্ল বোদলেয়ার ও পল ভেরলেনের মাতাল-অবস্হায়-থাকা হয়ে উঠেছিল এক ধরণের আধ্যাত্মিক নিয়মনিষ্ঠা ।

         পল ভেরলেন মধ্যস্হ, মীমাংসক, শান্তিস্হাপকের বেদিতে বসিয়েছিলেন শার্ল বোদলেয়ারকে । ভেরলেন লিখেছেন, “আমার কাব্যিক অনুভূতিকে, এবং আমার গভীরে যা রয়েছে, তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বোদলেয়র।” একুশ বছর বয়সে ভেরলেন লিখেছিলেন, “শার্ল বোদলেয়ার উপস্হিত করতে পেরেছেন সংবেদনশীল মানুষকে, এবং তিনি তাকে উপস্হাপন করেন একটি আদর্শ হিসাবে, বা বলা যায়, নায়ক হিসাবে ।” ভেরলেন আরও বললেন যে, শার্ল বোদলেয়ার “একজন দ্রষ্টা ; তাঁর রয়েছে তীক্ষ্ণ, স্পন্দমান সংবেদন, একটি যন্ত্রণাময় নিগূঢ় মন, তাঁর ধীশক্তি তামাকে প্লাবিত, তাঁর রক্ত বিশুদ্ধ সুরাসারে প্রজ্বলন্ত ।” যেহেতু অভিশপ্ত, তাই আশীর্বাদপূত ।

           বোদলেয়ারকে নায়কের বেদিতে বসিয়ে তাঁর জীবনযাত্রা অনুকরণের প্রয়াস করলেন পল ভেরলেন । মদে চোবানো অফিমের বদলে তিনি আসক্ত হলেন আবসাঁথে । আবসাঁথে আর কিছু মেশাতে হয় না, সরাসরি পান করতে হয় এবং গাঢ় নেশা হয় । বন্ধুরা নিষেধ করলে ভেরলেন তাঁদের সঙ্গে তরোয়াল বের করে মুখোমুখি হতেন । ভেরলেনের হাতে দেশলাই দেখলে তাঁর বন্ধুরা ভয় পেতেন । স্ত্রীর চুল সুন্দর বলে তাতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করেছিলেন । যখন ‘অভিশপ্ত কবি’ ভেরলেন লিখছেন, এবং দুঃখদুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছেন, তিনি জানতেন না যে তাঁর বেশ কিছু কবিতা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছেচে । কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে ক্ষোভ মৃত্যু পর্যন্ত ছিল যে তাঁকে আর তাঁর কবিতাকে কেউ ঠিকমতন বুঝতে পারেনি ; তাঁর মনে হতো একজন কবির কাব্যিক প্রতিভার কারণে যে আবেগের ঝড় তাকে পুষতে হয় তা লোকে টের পায় না ; প্রথানুসরণ সত্যকার শিল্পের শ্বাসরোধ করে, তাই সীমালঙ্ঘন জরুরি হয়ে ওঠে মৌলিকতাকে আয়ত্ব করার জন্য, নয়তো কবিতা হয়ে উঠবে আহরিত ; জীবনকে আত্মাহীন হলে চলবে না, তাকে হতে হবে অকৃত্রিম ও বিশ্বাসযোগ্য ।

          বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে, ইউরোপেও, অভিশপ্ত কবির যুক্তি খাটতো, কিন্তু এখন সেগুলো কিংবদন্তি মনে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় নৈতিক বিপথগামীতার নতুন সংজ্ঞা বাজারের চালচলনের সঙ্গে বদলাতে থাকে । এমনকি ভারতেও বোদলেয়ার বা ভেরলেনের মতন অভিশপ্ত কবির যুগ শামসের আনোয়ার ও ফালগুনী রায়ের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে । এখন এসেছে অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবির কালখণ্ডে । যাতে উপেক্ষার অভিশাপে না পড়তে হয় তাই কবি-লেখকরা এখন শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান । পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সময়ে যাঁরা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল করতেন তাঁরা অনেকেই তৃণমূলের মন্ত্রীর পাশে বসে ফোটো তোলাতে কার্পণ্য করেন না। রাষ্ট্র এখন এমনই বেপরোয়া যে কাকে কোন অভিযোগে জেলে পুরে দেবে তার নিশ্চয়তা নেই । কেবল রাষ্ট্র নয়, বিভিন্ন গোষ্ঠীও বুদ্ধিজীবিদের খুন করতে ভয় পায় না । নকশাল নামে একদা বহু বুদ্ধিজীবি লোপাট হয়ে ছিলেন ; এখন ‘শহুরে নকশাল’ নামে কয়েকজনকে জেলে পোরা হয়েছে । ধর্মবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্রের কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ।

         সমাজের যাঁরা নৈতিকতার জ্যাঠামশায়, তাঁরা সাহিত্যিকদের আত্মধ্বংসে সমাজেরই পচন দেখতে পান । বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে ইউরোপের সমাজে ও রাজনীতিতে বিপুল রদবদল ঘটছিল, যা আমরা দেড়শো বছর পরে ভারতেও প্রত্যক্ষ করছি । এখন ইউরোপ আমেরিকায় ধর্মহীনতা ও যৌন-যথেচ্ছাচারকে অধঃপতন মনে করা হয় না, যা ভেরলেনের সময়ে করা হতো । ১৮৫৭ সালে বোদলেয়ারের ছয়টি কবিতাকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা এখন ভারতীয় মাপকাঠিতেও হাস্যকর মনে হয় । ভেরলেনেরও মনে হয়ে থাকবে, যে, কবিতাগুলো কোন যুক্তিতে জনগণের নৈতিকবোধে আঘাত হেনেছে, যখন কিনা জনগণ নিজেরাই জীবনে বহু ঘটনা চেপে যায় । কলকাতায় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন কবি অবিনাশ কবিরাজ লেনে যেতেন অথচ আত্মজীবনী লেখার সময়ে তা চেপে গেছেন । বোদলেয়ারের ছয়টা কবিতা থেকে নিষেধ তোলা হয় ১৯৪৯ সালে । অথচ তার কয়েক বছর পরেই দেখা দিয়েছিলেন আমেরিকার বিট জেনারেশনের কবিরা ; অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ঝড় তুলেছে । প্যারিস থেকে তার আগে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হেনরি মিলারের ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’ । অতিযৌনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, নেশা ইত্যাদি সত্বেও হেনরি মিলার নিজেকে অভিশপ্ত মনে করেননি ।

          বোদলেয়ারের নিষিদ্ধ কবিতা ‘লিথি’, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে :

উঠে আয় আমার বুকে, নিষ্ঠুর নিশ্চেতনা

সোহাগী ব্যাঘ্রী আমার, মদালস জন্তু ওরে

প্রগাঢ় কুন্তলে তোর ডুবিয়ে, ঘণ্টা ভরে,

চঞ্চল আঙুল আমার -- হয়ে যাই অন্যমনা ।


ঘাঘরায় গন্ধ ঝরে, ঝিমঝিম ছড়ায় মনে

সেখানে কবর খোঁড়ে আমার এ-খিন্ন মাথা,

মৃত সব প্রণয় আমার, বাসি এক মালায় গাঁথা

নিঃশ্বাস পূর্ণ করে কি মধুর আস্বাদনে !


ঘুমোতে চাই যে আমি যে-ঘুমে ফুরোয় বাঁচা,

মরণের মতোই কোমল তন্দ্রায় অস্তগামী

ক্ষমাহীন লক্ষ চুমোয় তনু তোর ঢাকবো আমি--

উজ্বল তামার মতো ও-তনু, নতুন, কাঁচা ।


শুধু তোর শয়ন ‘পরে আমার এ-কান্না ঘুমোয়,

খোলা ঐ খন্দে ডুবে কিছু বা শান্তি লোটে ;

বলীয়ান বিস্মরণে ভরা তোর দীপ্ত ঠোঁটে

অবিকল লিথির ধারা বয়ে যায় চুমোয় চুমোয় ।


নিয়তির চাকায় বাঁধা, নিরুপায় বাধ্য আমি,

নিয়তির শাপেই গাঁথি ইদানিং ফুল্লমালা ;

বাসনা তীব্র যতো, যাতনার বাড়ায় জ্বালা--

সবিনয় হায়রে শহিদ নির্মল নিরয়গামী !


এ-কঠিন তিক্ততারে ডোবাতে, করবো শোষণ

ধুতুরার নেশায় ভরা গরলের তীব্র ফোঁটায়

ঐ তোর মোহন স্তনের  আগুয়ান দৃপ্ত বোঁটায়--

কোনোদিন অন্তরে যার হৃদয়ের হয়নি পোষণ ।

           সমালোচকদের স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না বোদলেয়ার, ফলে যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের পথে, তাঁর কবিতা সহজে কোনো পত্রিকা ছাপতে চাইছিল না, বোদলেয়ারের মনে হচ্ছিল অস্বীকার ও যন্ত্রণালাভের মধ্যে দিয়ে তাঁর স্খালন ঘটছে, কবিতায় ইতরতার সঙ্গে সৌন্দর্যের মিশেলে গড়া তাঁর পাঠবস্তুতে তিনি তাঁর প্রতি ঈশ্বরের অবিচারের প্রসঙ্গ তুলেছেন । তিনি এডগার অ্যালান পো-কে ফরাসী পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ে পো-এর জীবনেও মদ্যপানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যা তাঁর জন্য হয়তো জীবনবিনাশী ছিল, কিন্তু তা তাঁকে করে তুলেছিল প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ, কেননা, বোদলেয়ারের মতে,  পো কখনও নেশাহীন প্রকৃতিস্হ থাকতে চাইতেন না । বদল্যার বলেছেন যে পো সাধারণ মানুষের মতন মদ খেতেন না, খেতেন বর্বরদের ঢঙে, মার্কিনী তেজে, যাতে এক মিনিট সময়ও নষ্ট না হয়, যেন তিনি খুন করার জন্য তৈরি, এমন একটা পোকাকে খুন করতে চাইছেন যা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে আছে আর মরতে চায় না ।

         বদল্যারের মতে, মত্ততা এডগার অ্যালান পো-কে কেবল যে মহান কবি করে তুলেছে, তা নয়, তাঁকে করে তুলেছে মহান মানুষ ; পো-এর মত্ততা ছিল স্মৃতিবর্ধনের ক্রোনোট্রোপ ( সময়/পরিসর ), সাহিত্যকর্মের খাতিরে একটি সুচিন্তিত ও স্বেচ্ছাকৃত উপায়, তা মারাত্মক দুর্দশাপূর্ণ হলেও, তাঁর স্বভাবচরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল । ভেরলেন যেমন বদল্যারের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি, একই ভাবে বদল্যার আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি গড়ে তুলেছিলেন এডগার অ্যালান পো-এর মাধ্যমে ।

          উনিশ শতকের ফ্রান্সে যে কবিদের রচনা আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যকে রূপ দিয়েছে, তাঁদের প্রতি ফরাসি প্রাতিষ্ঠানিকতার দুর্ব্যবহার ব্যাখ্যার অতীত । ভেরলেন যাঁদের অভিশপ্ত কবি হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ভেরলেনের জীবনযাত্রা বেছে নেয়ায় পার্থক্য আছে । আবসাঁথের নেশার প্রতি ভেরলেনের টানের কারণ তিনি তাঁর ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানাননি, এবং আবসাঁথ খাবার পর যে সমস্ত দানবিক আচরণ তিনি করতেন তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই । অনেকে মনে করেন তাঁর বাবার পালিত মেয়ে এলিজা তাঁর সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে ভেরলেন হীনম্মন্যতায় ভুগতে আরম্ভ করেন এবং আত্মধ্বংসের দিকে এগিয়ে যান । পরবর্তীকালে তিনি তো যথেষ্ট রয়ালটি পেতেন এবং তা থেকে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধি আঁচ করে থাকবেন ।

         র‌্যাঁবোর অভিশপ্ত হবার কারণ পাওয়া যায় বাবার অনুপস্হিতিতে । তাঁদের পাঁচ ভাইবোনের কারোর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা বাড়িতে ছিলেন না । তাঁর যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে যান, ফলে শৈশব থেকে তাঁকে আর তাঁর মাকে টিটকিরি শুনতে হতো। তাঁর মা নিজেকে বলতেন বিধবা । অনুপস্হিত বাবাকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে র‌্যাঁবো ঈশ্বরনিন্দা ও খ্রিস্টধর্মকে আক্রমণ করেছেন তাঁর কবিতায় । ঈশ্বরই তাঁর ও তাঁর মায়ের দুঃখদুর্দশার জন্য দায়ি । সেই অনুপস্হিত বাবাকে তিনি প্যারিসের অগ্রজ কবিদের মধ্যে পেতে চেয়ে অবহেলিত হন । 

          ভেরলেনও জেলে থাকার সময়ে রোমান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তবু তিনি ঈশ্বরভক্তি ও ঈশ্বরনিন্দার মাঝে দোটানায় পড়ে কবিতা লিখেছেন । খ্রিস্টধর্মের প্রফেটদেরও যেহেতু যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে, যিশুকে ক্রূশকাঠে পেরেকে গেঁথা অবস্হায় ঝুলতে হয়েছে, তাই একজন কবিও, যে মানবসমাজের জন্য কবিতা লিখছে, তাকেও প্রফেটদের মতন অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হবে, মনে করেছেন ভেরলেন । আঘাত পাওয়াকে তাঁরা অপরিহার্য সত্য বলে মান্যতা দিয়েছেন । রসাস্বাদন করেছেন শহিদত্বের, জাহির করেছেন তাকে । মন্দভাগ্যের সাধনা তাঁদের অন্তরজগতকে বড়ো বেশি দখল করে নিয়েছিল, বিশেষ করে ভেরলেনের । খ্রিস্টধর্মমতে মানসিক অবস্হানটি ‘ইপিফ্যানি’ । এই মনস্হতিকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন ‘দৈব উন্মাদনা’, ইউরোপীয় রেনেসাঁর গবেষক বলেছিলেন ‘শনিআক্রান্ত স্বভাবচরিত্র’।

         যাঁরা আচমকা সেই ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হন, তাঁরা,  ‘বিশুদ্ধ’ অভিজ্ঞতার খাতিরে, মনের ভেতরে সন্ধান করেন সীমাহীনতার, যে পরিসরে তিনিই নিজেকে মনে করেন সর্বেসর্বা, আত্মক্ষয় তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না ; মাদক, যৌনতা, মৃত্যু, ধর্মহীনতা, কোনো কিছুই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, কেননা তিনি আত্মক্ষয়ের গৌরবে আহ্লাদিত  পরিসরের সার্বভৌম মালিক । সেই গায়ক, কবি, চিত্রকর, ভাস্কর, স্হপতির আহ্লাদের শক্তিক্ষমতা, তাঁদের যন্ত্রণাদায়ক যাত্রাপথে এগোনোয় প্ররোচিত করে ; তাঁরা জানেন যে প্রয়াস না করলে তাঁরা কিছুই নন, তাঁরা একজন ‘নেইমানুষ’ ।

         যৌনতা তাঁদের কাছে বংশরক্ষার অথবা সন্তানের জন্ম দেবার প্রক্রিয়া নয়, যেমন মাদক নয় নেশাগ্রস্ত থাকার জন্য, এগুলো তাঁদের ‘নেইমানুষ’ হতে দেয় না । বংশরক্ষা বা সন্তানোৎপাদনের যৌনতা,  ব্যক্তিঅস্তিত্বকে ধারাবাহিকতার বাইরে নিয়ে যায়, গতানুগতিকতায় বেঁধে ফ্যালে। ধারাবাহিকতাহীনতা হলো অভিশপ্ত কবিদের প্রতিদিনের জীবনের সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা । জনসাধারণের মাঝে একজনের সঙ্গে আরেকজনের বাধা থাকে, অনেকসময়ে দূরতিক্রম্য, ধারাবাহিকতাহীনতা থাকে, পতিত-অঞ্চল থাকে । মানুষের ব্যক্তিএকক-বোধ জন্মায় তার সামনের বস্তুপৃথিবীর জিনিসগুলোর ব্যবহারের কারণে — তাদের দরুণ বস্তুদের থেকে সে বিচ্ছিন্ন থাকে । ‘নেই-বোধ’ হলো অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, এবং এই ধারাবাহিকতার সন্ধান করেন আত্মক্ষয়ের আহ্লাদে আক্রান্ত অভিশপ্ত কবিরা । ‘নেই-বোধ’ হলো অহং-এর সমাপ্তি, যা মানুষটি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন, এবং সেই কারণেই আশেপাশের জনসাধারণকে সরিয়ে দিতে চাইছেন ।

         অমন মানুষটি আত্মবলিদানের গোমরে ভুগছেন কেন ? কেননা তাঁর কাছে আত্মবলিদানের গোমর হলো কেবলমাত্র ধ্বংস, তা নিশ্চিহ্ণ হওয়া নয় । আত্মবলিদানের গোমর বস্তুদের প্রতি আনুগত্যকে ধ্বংস করে ; প্রয়োজনীয় দৈনন্দিনের উপযোগীতাবাদী জীবন থেকে টেনে বের করে আনে, এবং মানুষটিকে প্রতিষ্ঠা করে দুর্বোধ্য খামখেয়ালে , স্বকীয় পবিত্রতায়, যার খোলোশা কেবল তিনিই করতে পারবেন । তাঁর এই ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ ঘটে তাবৎ সীমাগুলোর বিদারের মাধ্যমে, যাবতীয় নিষেধ অতিক্রমের দ্বারা, যা তাঁকে একযোগে আহ্লাদ ও পীড়নের স্হিতিতে নিয়ে গিয়ে একাকী ছেড়ে  দেয় । ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ হলো ‘নেই-স্হিতি’, এবং সেহেতু মানসিক ও দৈহিক আত্মক্ষয় সম্পূর্ণ পরিবর্তন-পরিশীলনের জন্য একান্তই জরুরি । অভিশপ্ত কবির ভেতরে-ভেতরে যে সন্ত্রাস চলছে তা অন্য কেউ তাঁকে দেখে বুঝতে পারে না ; তার জন্য তাঁর গানে, সঙ্গীতে, কবিতায়, ভাস্কর্যে, পেইনটিঙে, স্হাপত্যে, প্রবেশ করতে হবে ।

           ব্যক্তিএককের বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার ক্রোনোট্রোপে বাস্তব জগত আর মিথ মিলেমিশে গেলে তার যে মানসিক অবস্হা গড়ে ওঠে তাকে ভেরলেনের আলোচকরা বলেছেন ‘নুমিনাস’, যে অবস্হায় ব্যক্তিএককের অন্তরজগতে নিদারুণ তোলপাড় ঘটতে থাকে, সে তখন বাইরের জগতের প্রতি উৎসাহহীন, তার মনে হয় সে বাইরের জগতের দ্বারা অবদমিত, হতোদ্যম অবস্হায় সে নিজের ভেতরে আরও বেশি করে ঢুকে যেতে থাকে, তখন সে বিপজ্জনক আত্মক্ষয়ের স্বাদ পেতে আরম্ভ করেছে, খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে, বুঝে উঠতে পারছে না ঝাঁপ দেবে নাকি ফিরে যাবে ।

         সুইডেনের নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিণ্ডবার্গ, যিনি খাদের কিনারায় গিয়ে ফিরে এসেছিলেন, বেশ কিছু সময় মানসিক হাসপাতালে ছিলেন, তিনি নিজের অবস্হাটা যাচাই করে বলেছিলেন যে, ‘যারা উন্মাদ হবার সুযোগ পায় তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান’ । মার্কিন কবি জন বেরিম্যান, যাঁর বাবা শৈশবে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, এবং যিনি বাবার আত্মহত্যার স্মৃতি থেকে কখনও মুক্তি পাননি , বলেছিলেন, ‘যে কবি অত্যন্ত ভয়াবহ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে, যা তাকে মেরে ফেলতে পারতো অথচ যা তাকে প্রকৃতপক্ষে বাঁচতে সাহায্য করেছে, তার অদৃষ্টের প্রশংসা করা উচিত’।

    অভিশপ্ত কবির ভেতরে এক সৃজনশীল ক্ষমতা প্রবেশ করে ; সে চেষ্টা করে যায় যাতে বিস্ফোরণে সে নিজেই না উড়ে শতচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে চেষ্টা করে কখন সৃজনশীলতার আবেগ ও সংবেদনকে প্রয়োগ করতে হবে । সব সময় একটা ভীতি কাজ করে, কেননা সৃজনশীল মানুষটি খাদের ধার পর্যন্ত যাবেনই, আবার একই সঙ্গে তাঁর ভেতর এই ভীতি কাজ করে যে তিনি বড়ো বেশি মার্জিত রুচিশীল বিবেকী সুস্হতাবিশিষ্ট স্হিরমস্তিষ্ক হয়ে উঠছেন না তো ! সাধারণ মানুষের তুলনায় সৃজনশীল মানুষ, নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে খানিকটা ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হয়ে পড়েন, এবং ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হবার কারণে তাঁরা যখন ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হন তখন, সাধারণ মানুষের তুলনায়, অস্তিত্বের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে পারেন, অন্তদর্শী হতে পারেন, প্রতিক্ষেপক হতে পারেন । আমেরিকায় লেনি ব্রুস নামে একজন প্রতিসাংস্কৃতিক কমেডিয়ান ছিলেন, অশ্লীল ভাষায় সবায়ের সমালোচনা করতেন, যে কারণে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল,  এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা মাফ করে দেয়া হয়, তিনি উন্মাদ বুদ্ধিমত্তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তিনি নিজেও আত্মক্ষয়ে ভোগেননি ।

         ডাক্তারি ভাষায় আত্মক্ষয়ের গৌরবকে বলা হবেছে ‘হাইপোম্যানিয়া’ । কোনো সৃজনশীল মানুষকে যদি হাইপোম্যানিয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাহলে তাঁর কাছে তা সৃজনের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি । সৃজনশীল মানুষ তাঁদের কাজের জন্য যে কাঁচা মাল ব্যবহার করেন, তা আসে তাঁদের অন্তর্জীবনের বুনিয়াদি বা আদিকালীন স্তর থেকে — যৌন কল্পনা, পূর্বপক্ষতা, আগবাড়া চারিত্র্য, বহুবিধ যৌনাঙ্গিকের ভাবনা থেকে । শৈশব থেকে মানুষের ভেতরে এই বোধগুলো কাজ করে, সে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে যৌবনে পৌঁছোয় । বয়সের সঙ্গে সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, আদিম-চেতনাকে দাবিয়ে রাখতে শেখে, সামাজিক বাধানিষেধকে মান্যতা দিতে শেখে । কিন্তু সৃজনশীল মানুষ এগুলোর সংস্পর্শে থাকেন, আর তাদের বোঝার জন্য নিজের সঙ্গে লড়তে থাকেন, আর নিজের আদিম চারিত্র্যের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার অভিপ্রায়ে তিনি উন্মাদনা ও মতিস্হিরতার মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন আবার কখনও বা সেই ভারসাম্য হারিয়ে অভিশপ্ত হন।


তিন

          পল-মারি ভেরলেনের জন্ম ১৮৪৪ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপূর্ব ফ্রান্সের মোৎসেল আর সেইলি নদীর সঙ্গমস্হল মেৎজ শহরে ।   সমরবাহিনীর ক্যাপ্টেন তাঁর বাবা নিকোলাস অগুস্তে ভেরলেন  ১৮৫১ সালে মেৎজ থেকে প্যারিসে পাকাপাকি  বসবাসের জন্য চলে যান । সেখানে পল ভেরলেনকে বোনাপার্ত উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় । স্কুলের তথ্য অনুযায়ী চোদ্দো বছর বয়সে তাঁকে দেখতে কুৎসিত মনে হতো । জীবনের প্রথম সাত বছর বাবার চাকুরির দৌলতে বিভিন্ন শহরে বসবাস করতে হয়েছিল ভেরলেনকে, যার দরুণ শৈশবে তাঁর একমাত্র বন্ধু ছিলেন তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া খুড়তুতো বোন এলিজা । এলিজার অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কিশোর ভেরলেন ; এলিজা  ছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম,  যদিও এলিজার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর একটা বাচ্চা ছিল তবু ভেরলেন তাঁকে দৈহিকভাবে চেয়েছিলেন; এলিজাকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘দুর্দান্ত উৎসব’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, এলিজার মৃত্যুর পর । 

           ১৮৬২ সালে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  ভেরলেন প্রথমে বীমা কোম্পানির  চাকুরিতে যোগ দেন। ১৮৬৫ সালে তাঁর বাবা মারা যান । দুই বছর আইন পরীক্ষা পড়ার পর ছেড়ে দ্যান। ১৮৬৭ সালে  এলিজা মোনকোঁলের মৃত্যুর ফলে তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন আর বেয়াড়া হয়ে যান, বাবা-মায়ের কাছে তাঁর আবদার বেড়ে যায়, খামখেয়ালি, অব্যবস্হিতচিত্ত, স্বার্থপর, অপরিণত যুবক হয়ে ওঠেন ।  তাঁর মা মদ খাবার টাকা যোগাতেন না বলে বাড়িতে প্রায়ই ঝগড়া হতো । উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁর আবসাঁথ খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । মদ্যপ অবস্হায় দু’বার মাকে খুন করার জন্য তাঁর পেছনে তরোয়াল নিয়ে দৌঁড়েছিলেন । ভেরলেনের বন্ধু তাঁদের দুজনের মাঝে গিয়ে ভেরলেনকে কাবু করেন । মাকে দ্বিতীয়বার আক্রমণের ব্যাপার চলেছিল সাত ঘণ্টা কথা কাটাকাটির মাঝে । মা পরের দিন সবকিছু ভুলে গিয়ে আদরের ছেলেকে ক্ষমা করে দিতেন ।

         শার্ল বোদলেয়ারের ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ) পড়ার পর পল ভেরলেনের কবিতা লেখার ইচ্ছা হয়। ১৮৬৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মসিয়ঁ প্রুধোম’ প্রকাশিত হয় । তিনি ‘সমসাময়িক কবিতা’ ( Le Parnasse Contemporain ) পত্রিকার সম্পাদক কাতুলে মেনদেস-এর সঙ্গে দেখা করেন । পত্রিকাটিতে তাঁর আটটি কবিতা প্রকাশিত হয় । উনিশ শতকের ফ্রান্সে একদল কবি আরম্ভ করেন পারনাসিয় আন্দোলন ; নামটি নেয়া হয়েছিল অ্যাপোলো আর মিউজদের পবিত্র গ্রিক পাহাড়ের নাম থেকে । পারনাসিয়রা বিষয়বস্তু এবং শৈলীর বিস্তার প্রদর্শন করলেও, তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন কারিগরি, অশেষ সৌন্দর্য ও বস্তুনিষ্ঠাকে। রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দিয়েছিল পারনাসিয় আন্দোলন এবং তা ক্রমে প্রসারিত হয় প্রতীকবাদ ও ডেকাডেন্ট কাব্যিক ঐতিহ্যে । পারনাসিয় আন্দোলনের প্রধান কবি বলে মনে করা হয় শার্ল-মারি-রেনে লেকঁত দ্যলিজেকে, কিন্তু আন্দোলনের অংশ হিসাবে মান্যতা দেয়া হয় থিয়োদোরে দ্যবাঁভিল, অঁরি কাজালিস, ফ্রাঁসোয়া কোপি, আনাতোল ফ্রাঁসে, থিয়োফিল গতিয়ে, জোসে-মারিয়া দ্যহেরদিয়া, সালধ প্রুধোম, পল ভেরলেন ও শার্ল বোদলেয়ারকে। ১৮৬৬, ১৮৭১ ও ১৮৭৬  সালে সবসুদ্ধ নিরানব্বুইজন কবির তিনটি সংকলন প্রকাশ করেন আলফোঁসে লেমেরে, কাতুলে মেন্দেস আর লুই জেভিয়ার । এই তিনটি সংকলনের প্রকাশকে ফরাসী সাহিত্যে বাঁকবদলকারী ঘটনা বলে মনে করা হয় । তবে থিয়োফিল গতিয়ে যখন ‘আর্ট ফর আর্টস শেক’ স্লোগান দিলেন তখন পারনাসিয় কবিরা একটা বৌদ্ধিক গতিমুখ পেলেন । ভেরলেন নিজেকে পারনাসিয় আন্দোলনের একজন সদস্য বলে মনে করতেন না ।

           ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ভেরলেনের প্রথম কাব্যগ্রন্হ Poemes Saturniens এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হ Gallant Parties প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে । মেনদেসের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে অন্যান্য পারনাসিয় কবি লেকঁতে দ্যলিজে, থিয়োদির দ্য বাঁভিল, লুই জেভিয়ার দ্য রিকার্দ, ফ্রাঁসোয়া সিপ্পি প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এবং সুফলো রোড-এর সস্তা মদের দোকানে সবাই মিলে আড্ডা দিতেন । বিয়ারের স্বাদ সেসময়ে ভালো ছিল না বলে আবসাঁথের প্রতি আসক্ত হন ভেরলেন ও অন্যান্য কবিরা । ভেরলেন নিজেই ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানিয়েছেন যে তিনি একবার সারারাতে দুশোবার অর্ডার দিয়ে আবসাঁথ খেয়েছিলেন । Poemes Saturniens এর “হেমন্তের কবিতা” লিখে ভেরলেন কবিদের প্রশংসা পেয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই কবিতাটির প্রথম ছয় লাইন মিত্রপক্ষের সৈন্যবাহিনী নরম্যাণ্ডি অবতরণের কোড হিসাবে বিবিসি থেকে প্রসার করেছিলেন ; প্রথম তিন লাইন পয়লা জুন আর দ্বিতীয় তিন লাইন পাঁচুই জুন :

হেমন্তের বেহালার

দীর্ঘ ফোঁপানিগুলো

আমার হৃদয়কে আহত করে

একঘেয়ে সুরের অবসাদে ।

সমস্তকিছু শ্বাসহীন

আর ফ্যাকাশে, যখন

সময়ের কাঁসর বেজে ওঠে,

আমার মনে পড়ে

বিগত দিনগুলো

আর আমি কাঁদি

আর আমি চলে যাই

এক অশুভ বাতাসে

যা আমাকে নিয়ে যায়

এখানে, সেখানে,

যেন গাছের এক

মৃত পাতা ।

          বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটির শিরোনাম যদিও ‘হেমন্তের গান’, প্রতীকবাদী অন্যান্য কবিদের মতো ভেরলেনও, র‌্যাঁবোর সঙ্গে পরিচয়ের আগে, ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’কে মান্যতা দিয়ে কবির অন্তরজগতকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং তিনি যে বলতেন কবিতাকে সঙ্গীতময় হয়ে উঠতে হবে, তার পরিচয় মেলে এই কবিতায় ; তিনি বলতেন যে কবিতায় সঙ্গীতই প্রথম এবং প্রধানতম । যাঁরা কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য, ফরাসি ভাষায় না পড়লে কবিতাটির সঙ্গীতময়তা অনুধাবন করা যায় না । এই কবিতাটির অনুকরণে উনিশ শতকের শেষ দিকে বহু কবি কবিতা লিখেছেন । এই কবিতার আনুয়ি বা অবসাদ হয়ে ওঠে ভেরলেনের কবিতার বৈশিষ্ট্য। ভেরলেনের কবিতায় ক্ষয় বা অপচয় ঘুরে-ঘুরে এসেছে । কবিতাটির ধীর লয় কবির অবসাদকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োগ করেছেন ভেরলেন । পারনাসিয় কবিদের প্রভাবে র‌্যাঁবো ‘দি ড্রাঙ্কন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু পরে নিজেই এই কবিতার ধারাকে সমর্থন করেননি, এবং গদ্যকবিতার দিকে ঝোঁকেন ।

          উনিশ শতকের প্যারিসে লাতিন কোয়ার্টার ছিল যেন এক বোহেমিয়ান দ্বীপ, যেখানে জড়ো হতেন অজস্র লেখক, শিল্পী, নাট্যকার আর কবিযশোপ্রার্থী । ভিক্তর য়োগো, শার্ল বোদলেয়ার প্রমুখের মতন পল ভেরলেনও বেছে নিয়েছিলেন এলাকাটা, সস্তার মদ আর বেশ্যাসঙ্গের আকর্ষণে । প্যারিসের ইতিহাসে এই সময়টাই ছিল প্যারিস কোয়ার্টারের খ্যাতি-কুখ্যাতির কারণ -- এখন তা একেবারে বদলে গিয়েছে । যারা এই এলাকায় বাস করতো তাদের কাছে পাড়াটা ছিল নরক । অত্যন্ত গরিব শ্রমজীবিদের পাড়া, দুবেলা খাবার জোটেনা, অসুখে পড়লে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয় ইত্যাদি । তারা প্রধানত গ্রামাঞ্চল থেকে এসে সস্তায় থাকার জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিল পাড়াটা, আর বাড়তি রোজগারের জন্য ঘর ভাড়া দিতো, বেশ্যাগিরি করতো, সস্তার মদ বিক্রি করতো । ক্রমশ তারা লেখক-কবি-শিল্পীদের চাহিদা মেটাবার জন্য সারারাতের যৌনহুল্লোড়ের ব্যবস্হা করতো । ফরাসি সাহিত্যে দেখা দিচ্ছিল রোমান্টিক ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তা, আদর্শের পরিবর্তে ‘পাপের ফুলের’ বা ‘নরকে ঋতুর’ প্রতি আকর্ষণ । ফাউস্তের জায়গা নিয়ে নিচ্ছিল মেফিসতোফিলিস । ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়ে দোটানায় ছিলেন কবি-লেখক-শিল্পীরা । পেত্রুস বোরেল নামে এক কবি, যিনি বোদলেয়ারের বন্ধু ছিলেন, লাতিন কোয়ার্টারে গরিব সেজে ঘুরে বেড়াতেন, তাঁকে বলা হতো “নেকড়ে বাঘে পরিণত মানুষ।”                       

           ভেরলেনের মতিগতি ফেরাবার জন্য তাঁর মা তাঁর বিয়ে প্রথমে ঠিক করেন কড়া মেজাজের এক মামাতো বোনের সঙ্গে,  কিন্তু তা এড়াবার জন্য ভেরলেন পছন্দ করেন এক বন্ধুর সৎবোন,  তাঁর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো  সুন্দরী তরুণী মাতিলদে মত দ্য ফ্ল্যেওরভিলেকে, বিয়ে হয় ১৮৭০ সালে ; মাতিলদের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে যুবতীটির বয়স ছিল ষোলো, তাঁর মা-বাবা ভেরলেনকে জানান যে তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে । ১৮৬৯ সালের জুনমাসের এক দুপুরে, মদ খাবার জন্য বন্ধু শালর্ক দ্য সিভরির মমার্তর বাড়িতে গিয়েছিলেন পল ভেরলেন । শার্ল তাঁর মা আর সৎবাবা থিওদোর মতে দ্য ফ্লেওরভিলের সঙ্গে থাকতেন । দুই বন্ধু যখন গল্প করছিলেন তখন ষোলো বছরের একটি সুন্দরী যুবতী ঘরে ঢোকেন, ভেরলেনের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢোকেন, তিনি শার্লের সৎবোন মাতিলদে মতে । ভেরলেনের কবিতা তাঁর পড়া ছিল এবং পড়ে কবিকে ভালো লেগেছিল, তিনিও ভেরলেনের প্রেমে পড়েন । বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই মাতিলদে গর্ভবতী হবার দরুন ভেরলেন বিষাদে আক্রান্ত হয়ে আবার লাতিন কোয়ার্টারে যাতায়াত আরম্ভ করেন ।তাঁদের একটি ছেলেও হয় ।  

         মাতিলদে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে প্রথম দুই বছর ভেরলেন তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। ভেরলেনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্হ ‘ভালো গান’-এর কবিতাগুলো  মাতিলদেকে মনে করে লেখা । কিন্তু মাঝে-মাঝে ভেরলেনের রুদ্ররূপ বেরিয়ে পড়তো আর তিনি মাতিলদের গায়ে হাত তুলতেন । একবার তিনি মাতাল অবস্হায় তাঁর ছেলে জর্জকে তুলে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন । তাঁর মা, শশুর-শাশুড়ির উপস্হিতিতেও এরকম আচরণ করতেন তিনি ।

          ভেরলেন  মিউনিসিপালিটির সরকারি চাকরিতে যোগ দেন  ১৮৭০ সালে । কিন্তু তৃতীয় নেপোলিয়ানের পতনের পরবর্তী দ্রোহের সময়ে প্যারিস-শহর ও চাকরি ছেড়ে পালান । ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ১৮৭১ পর্যন্ত প্রুসিয় সেনারা প্যারিস শহর ঘিরে ফরাসিদের জব্দ করতে চায় । সমস্ত কিছুর অভাব দেখা দেয় । কবি-লেখকরা লাতিন কোয়ার্টারের যে পাড়ার পানশালায় গিয়ে আড্ডা দিতেন সেখানেের ভোজন-তালিকায় ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল এমনকি ইঁদুরের মাংস বিক্রি হতো । নারী আর পুরুষ বেশ্যারা এই খাবার একপেট খাবার বিনিময়ে সঙ্গমে রাজি হয়ে যেতো । এই সময় খবর রটে যায় যে বিসমার্ক পরামর্শ দিয়েছেন প্যারিসের ওপরে চারিদিক থেকে কামান দাগা হোক, কিন্তু ব্লুমেনথেল তা সামলে দেন এই তর্কে যে ফরাসি সেনার বদলে সাধারণ মানুষ তাতে মারা পড়বে । ভেরলেনসহ অনেকেই, যাঁরা প্যারিস কমিউনে যোগ দিতে চাননি, তাঁরা প্যারিস ছেড়ে পালান । ভেরলেন অবশ্য কমিউনের প্রেস অফিসার হিসাবে ১৮৭০-এ কাজ করেছিলেন আর কমিউন ভেঙে যাবার পর রাস্তায়-রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হলে অন্যান্য কবি-লেখকদের সঙ্গে গা ঢাকা দেন  ।

          পল ভেরলেনের জীবনযাত্রা, অপরাধ আর সাধাসিধে ছলাকলাশূন্যতার মাঝে দোল খেয়েছে । স্তেফান মালার্মে ও শার্ল বোদলেয়ারের সঙ্গে তাঁকে প্রতীকবাদী কবিতার ত্রিমূর্তির অন্তর্গত করলেও, দুটি প্রতীতি প্রাধান্য পায় : প্রথম হল যে কবির অহং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ; দ্বিতীয় যে কবিতার কাজ হল চরম সংবেদন ও একক ধৃতির মুহূর্তগুলোকে অক্ষুণ্ণ রাখা । Poemes saturniens ( ১৮৬৬ ) কাব্যগ্রন্হে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “একে মিলোর তৈরি ভেনাস বলা হবে নাকি নিছক শ্বেতপাথর ?” তাঁর কবিতায় আপাত-অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা সত্বেও, তিনি কবিতার কারিগরিতে সহজ ও সঙ্গীতময় শব্দ প্রয়োগ করে সাবধানি কারুনৈপূণ্য বজায় রেখেছেন । ফরাসি ধ্রুপদি কবিতার খোলোসের মধ্যে থেকেও ছন্দবর্জনের খেলা খেলেছেন, যেমন ১৮৭৪-এ রচিত Romances sans Paroles কবিতায় লিখেছেন :

“আমার হৃদয়ে ক্রন্দন

শহরে বৃষ্টি পড়ার মতো”

          মাতিলদেকে নিয়ে ভেরলেন ভালোবাসার অনেকগুলো কবিতা লিখেছিলেন Le bonne chanson ( The Good Song ) কাব্যগ্রন্হে । কয়েকটার বাংলায়ন :

এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে

এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে,

এক গিন্নিমা তাঁর মিনারে,

মহিমা ও ভালোবাসা

যা মানুষের শব্দাবলীতে আছে ;

সোনার বার্তা যা বাঁশি

বহুদূরের বনানী থেকে বাজায়,

অবলা গর্বের সঙ্গে বিবাহিত

যা বহুকাল আগের মহিমাময়ীদের ;

তার সাথে, ধরা পড়ে না এমন সৌন্দর্য

এক তরতাজা বিজয়িনী হাসির

যা ফুটে উঠেছে রাজহাঁসের পবিত্রতায়

আর এক নারী-শিশুর লজ্জায় ।

মুক্তার মতো আদল, শাদা আর গোলাপি,

এক মৃদু অভিজাত স্বরসঙ্গতি :

আমি দেখি, আমি এই সবকিছু শুনতে পাই

মেয়েটির শার্লমেনিয় বংশধরের নামে ।


আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম ...

আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম,

বেদনাদায়ক অনিশ্চিত

তোমার প্রিয় হাত  ছিল আমার পথনির্দেশক।


তাই দূরে দিগন্তের উপর ফ্যাকাশে

ভোরের একটি দুর্বল আশা ছড়াচ্ছিল দ্যুতি;

তোমার দৃষ্টিতে ছিল ভোর।


চারিদিক নিঃশব্দ, তোমার সুরেলা পদক্ষেপ ছাড়া শব্দ নেই,

ভ্রমণকারীকে উত্সাহিত করেছো তুমি।

তোমার কন্ঠস্বর আমাকে বলেছিল: "এগিয়ে চলো !"


আমার ভয়ঙ্কর হৃদয়, আমার ভারী হৃদয়

একা কেঁদেছিল দুঃখের পথযাত্রায়

ভালবাসা, আনন্দদায়ক বিজয়ী,

আমাদের আনন্দের বাঁধনে আবার  একত্র করেছে।

       ১৮৬৫ সালে শার্ল বোদলেয়ার সম্পর্কে লেখা দুটি প্রবন্ধে ভেরলেন জানিয়েছিলেন যে একজন কবির অন্বেষন কেবল সৌন্দর্য । কবিতা রচনায়, তিনি বলেছেন, প্রেরণা আর আবেগের যৎসামান্য স্হান থাকলেও কবির থাকা দরকার কারিকুরির সৃষ্টিশীলতা । ব্যক্তিগত আবেগকে যদি ব্যবহার করতে হয় তাহলে ছন্দ, ধ্বনি এবং চিত্রকল্পকে একত্রিত করে একটি কাব্যিক সঙ্গীত গড়ে নিতে হবে এবং সেই জগতে কোনোকিছুই আপতনিক নয় । ভেরলেনের কারিগরির ফল হল তাঁর কবিতার সঙ্গীতময়তা ; ধ্বনিরা একত্রিত হয়ে এক সুরেলা ঐকতান সৃষ্টি করে । ১৮৮২ সালে তিনি বলেছিলেন, “L’Art poetique” কবিতায়, “কবির উচিত বিজোড়-মাত্রার পঙক্তি, যথাযথ-নয়-এমন শব্দভাঁড়ার এবং প্রচ্ছন্ন চিত্রকল্প ব্যবহার করা ; রঙের বদলে অতিসূক্ষ্ম তারতম্যকে গুরুত্ব দেয়া । কবিকে ইচ্ছাকৃত ছন্দ, বৈদগ্ধ্য ও বাগ্মীতা এড়াতে হবে । কবিতা হবে হালকা, বাতাসে ভাসমান, যৎসামান্য সুগন্ধময় ও ক্ষণিক । এছাড়া সমস্তকিছু কবিতা হয়ে ওঠার পরিবর্তে হয়ে উঠবে সাহিত্য ।” 

          সমসাময়িক বাস্তববাদ এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ অলঙ্কার বর্জন করে অন্যান্য প্রতীকবাদী কবিদের মতো পল ভেরলেনও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন মেজাজ, সত্তা । তাঁর কাব্যগ্রন্হ Fetes gallantes  এর অন্তর্গত Clair de Lune ( Moonlight ) “চাঁদের আলো” কবিতাটিকে মনে করা হয় তাঁর সবচেয়ে ভালো কাজ । যেভাবে চাঁদ তার আলো সূর্য থেকে পায়, ভেরলেন চাইলেন এমন বিষয়বস্তু বেছে নিতে যা সহজে অভিগম্য নয়, তাই চাঁদের মতো পরোক্ষভাবে বিষয়বস্তুকে দীপ্ত করতে চাইলেন, যা প্রতিফলন সৃষ্টি করে ।

           ভেরলেনের কবিতাটিতে আছে মুখোশ আর নৃত্য, অভূতপূর্ব ছদ্মবেশ, আহ্লাদিত ঝর্ণাদের ফোঁপানি, চাঁদের আলো : বিশেষকিছু না বলেই কবিতাটিতে ইশারামূলক ছবির স্লাইড চলে যায় একের পর এক । ডেভিড ওইসত্রাখ ও ফ্রিদা বাওয়ের এই কবিতাটিকে নিয়ে একটি নৃত্যনুষ্ঠান করেছেন । ক্লদ দেবুসি, রেনাল্দো হাহন, পোলদোস্কি, গুস্তাভ কার্পেন্তিয়ের এবং গ্যাব্রিয়েল ফাওরে নিজেদের মতো করে সুর দিয়েছেন কবিতাটিতে । ইংরেজিতে যাঁরা অনুবাদ করেছেন তাঁরা বলেছেন কবিতাটি অনুবাদ করা কঠিন। 


Moonlight

Your soul is like a landscape fantasy,

Where masks and Bergamasks, in charming wise,

Strum lutes and dance, just a bit sad to be

Hidden beneath their fanciful disguise.


Singing in minor mode of life's largesse

And all-victorious love, they yet seem quite

Reluctant to believe their happiness,

And their song mingles with the pale moonlight,


The calm, pale moonlight, whose sad beauty, beaming,

Sets the birds softly dreaming in the trees,

And makes the marbled fountains, gushing, streaming--

Slender jet-fountains--sob their ecstasies.

          আমি এখানে শুভদীপ নায়কের করা বাংলা অনুবাদ দিলুম । উনি নামকরণ করেছেন ‘জ্যোৎস্না’

জ্যোৎস্না

( clair de lune / Moonlight)

 

তোমার অন্তর এক প্রশস্ত কল্পনার মতো

সেখানে মুখোশ ও মুখশ্রী দুই-ই প্রজ্জ্বলিত

বীণার তার এবং নৃত্য, যা আসলে বেদনামথিত

তোমাকে লুকিয়ে রাখে সৌন্দর্যের আড়ালে

 

সঙ্গীতকে ধীরে ধীরে করে তোলো বৃহৎ জীবন

ভালবাসাময়, নিশ্চল ও শান্ত

তাদের সুখের ওপর বজায় রাখো বিশ্বাস

সেইসব সঙ্গীত তুমি ধরে রাখো জ্যোৎস্নায়

 

শান্ত পরাভব সেই জ্যোৎস্না, অপূর্ব ক্লেশে বিকশিত

পাখিদের মতো এসে বসে স্বপ্নময় গাছের ডালে

হয়ে ওঠে ঝর্ণা, চিত্তের প্রবাহ

ঝর্ণার ঋজুতায়, -- নিজস্ব উল্লাসে

          একজন মানুষের আত্মার রুপকশোভিত ছবিতে, ‘চাঁদের আলো’ জাগিয়ে তোলে সৌন্দর্য, ভালোবাসা আর প্রশান্তির আকাঙ্খা । কবিতাটি থেকে ক্রমবর্ধমান হতাশার যে আবহ গড়ে ওঠ তাতে পাওয়া যায় ভেরলেনের আত্মমগ্নতার কন্ঠস্বর । ভেরলেন পাঠকের মনে সন্দেহ তৈরি করতে চেয়েছেন, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয়, বাস্তবে কি সত্যিই ভালোবাসা আর আনন্দ পাওয়া সম্ভব । প্রধান উপমাটিকে প্রয়োগ করে তিনি বলতে চেয়েছেন যে প্রত্যেক মানুষই তার অন্তরজগতে একটা ভূদৃশ্য বহন করে, আর এই ক্ষেত্রে, যে উপাদান তৈরি হয় তা হলো একই সঙ্গে সুন্দর আর আশাহীন । অস্তিত্ব এবং যা দেখা যাচ্ছে, তার বৈপরীত্য কবিতাটির গুরুত্বপূর্ণ থিম । দৈহিক সৌন্দর্য আর বিষাদের মিশ্রিত অবস্হান ভেরলেন পেয়েছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে । তাঁর মতে, মানুষের জীবনে এবং আত্মায়, অর্থাৎ মৃত্যুর পর, তার নিখুঁত হবার প্রয়াস কখনও পুরণ হবে না । জীবনের সত্যকার সত্তা উপরিতলে পাওয়া যাবে না ।

          ভেরলেনের সযত্নে রচিত কবিতার বনেদ প্রায়শই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর, নিঃসন্দেহে নাটকীয় এবং আবেগমথিত বিষয়বস্তু । তাঁর “Poemes saturniens”     প্রস্তাবনায় স্পষ্ট যে তিনি নিজের অবজ্ঞাত, দৈন্যপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্ত নিয়তি আঁচ করতে পেরেছিলেন । এই কাব্যগ্রন্হের সব কয়টি কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন অসুখী থাকার স্বপূরক প্রত্যাশার একাধিক বিন্যাস । আনন্দের ক্ষণিক মুহূর্ত ভেরলেনের  সমস্ত কবিতায় ছেয়ে আছে । এমনকি “Sagesse” গ্রন্হে, যেখানে রোমান ক্যাথলিক রহস্যময়তার কথা বলেছেন, এবং বলেছেন যে তাতেই আছে সর্বোচ্চ আনন্দ, ঈশ্বরের সঙ্গে শান্তিময় আলাপনের সময়েও তিনি অধঃপতনের সময় ফিরে আসার ভয়ে আতঙ্কিত । যেহেতু যৌনতা, ঈশ্বর আর আবসাঁথ তাঁর ‘শনিআক্রান্ত নিয়তি’ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, তাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত অন্য আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে, এবং তা হল ঘুম । শেষ দিকের কবিতায় বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে ঘুমের কথা, চিত্রকল্পগুলো ঘুমের, যেন কমনীয় ঘুমপাড়ানি গানের মনোরম ছবি -- তা থেকে রঙ, হাসি, তীক্ষ্ণতা, জমকালো, মাত্রাধিক ধ্বনি বাদ দেয়া হয়েছে -- কবির ক্ষতবিক্ষত মনকে ঘুমের আরামে শান্তি দিতে পারে । বেশ কিছু কবিতায় এক মাতৃমূর্তিকে পাওয়া যায় দোলনার পাশে কিংবা এক মাতৃমূর্তি লক্ষ রাখেন ঘুমন্ত কবির পাশে দাঁড়িয়ে । যে কবিতায় ঘুমের মোটিফ নেই, তাতেও কবিতার শেষের পঙক্তিগুলোয় এসেছে মুছে যাবার রিক্ততাবোধ ।

          আলোচকরা ভেরলেনকে তাঁর কবিতার শিল্পানুগ ও গভীর অনুভূতির বৈশিষ্ট্যের কারণে ফরাসী প্রতীকবাদের অগ্রদূতদের একজন হিসাবে চিহ্ণিত করলেও, তিনি তাঁর কবিতাকে ডেকাডেন্ট বা প্রতীকবাদের তকমা দিতে অস্বীকার করে বলেছেন যে তিনি নিজেকে একজন ‘ডিজেনারেট’ বা অপজাত কবি বলতে চাইবেন, কেননা তাঁর কবিতায় থাকে অহংকার ও অরাজকতার প্রবণতা ; প্রতীকবাদীদের তুলনায় তিনি প্রচলিত ভাষাকে সঙ্গীতময় করেছেন তাঁর কবিতায়। প্রকৃতপক্ষে ভেরলেনের জীবনের ঘটনাবলী ছেয়ে ফেলেছে তাঁর কবিতার গুণাগুণ ও কাব্যিক প্রতিভা । যেমন তাঁর জীবনে, তেমনই তাঁর কবিতায়, অবিরম লড়াই দেখা যায় তাঁর অন্তরজগতের সঙ্গে তাঁর ইন্দ্রিয়ের, লাম্পট্য ও পশ্চাত্যাপের । তাঁর চরিত্রকে আক্রমণ সত্বেও, ভেরলেনকে মনে করা হয় একজন সুসম্পূর্ণ কবি, যাঁর অসাধারণ প্রতিভা দেখা যায় কবিতার অঘনিভূত মাত্রায়, ইশারামূলক ও লাক্ষণিক ভাষায় এবং প্রতিচ্ছায়াময় বাক্যালঙ্কারে । ফরাসি কবিতাকে ভেরলেনই পরিভাষাগত প্রাবল্যের বাইরে বের করে আনেন এবং ফরাসী ভাষার সহজাত সঙ্গীতময়তাকে ব্যবহার করা আরম্ভ করেন । তিনি বলেছেন কবিতা হওয়া উচিত  সুখশ্রাব্য ও সন্মোহক, অস্পষ্ট ও দ্রবনীয় ; পাঠক কবিতাকে বিভিন্ন থিমে চিহ্ণিত করতে পারবেন, এমন কবিতা লেখা তিনি পছন্দ করেন না  । সেকারণেই তাঁর কবিতার অনুবাদে তাঁকে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় না। তাঁর বক্তব্য বোঝাবার জন্য ভেরলেন কবিতার শিল্প (Art Poetique )    শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ; আমি বাংলায়নের চেষ্টা করেছি :

 সবকিছুর আগে সঙ্গীতময়তা--

আর এর জন্য আরও অস্বাভাবিকতা--

অস্পষ্ট ও আরও বেশি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া, 

তাকে ভার বইতে হয় বা বেঁধে ফেলতে হয় তাকে বাদ দিয়ে দাও

তাকে এমন হতে হবে যে তুমি খুঁজে বেড়াবে

তোমার শব্দগুলোয় কোনোরকম গাফিলতি ছাড়াই :

ধূসর গান ছাড়া প্রিয় আর কিছু নেই

যেখানে বিচলন ও যথাযথের মিল হয় ।

আনেকটা কালোজালের আড়ালে সুন্দর চোখের মতন, 

অনেকটা ছড়িয়ে-পড়া দুপুরের স্পন্দনের মতন,

অনেকটা ( যখন হেমন্তের আকাশ শোভনীয় করে তোলে )

সুস্পষ্ট নক্ষত্রদের নীল বিশৃঙ্খলা !

কেননা আমরা আরও বেশি চাই সূক্ষ্ম তারতম্য--

রঙ নয়, সূক্ষ্ম তারতম্য ছাড়া কিছু নয় !

ওহ ! কেবল সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে আসে

স্বপ্নকে স্বপ্নের মধ্যে আর বাঁশিকে শিঙায় !

খুনির ধারালো বক্তব্য থেকে দূরে রাখো,

নিষ্ঠুর বৈদগ্ধ  আর পঙ্কিল হাসি,

যা নীল শূন্যতার চোখে অশ্রূজল এনে দ্যায়---

আর মৃদু আঁচের যাবতীয় রসুনরান্না ।

বাগ্মীতাকে ধরে তার ঘাড় মুচড়ে দাও !

তোমার তাতে ভালো হবে, কর্মচঞ্চল মেজাজে,

যাতে কবিতার মিলকে কিছুটা সুবিচার করা যায় ।

যদি না লক্ষ রাখা হয়, তাহলে তা কোথায় যাবে ?

ওহ, কে আমাদের বলতে পারে মিলের ভ্রষ্ট আচরণ ?

কোন বধির বালক কিংবা উন্মাদ কালো মানুষ

আমাদের জন্য বানিয়েছে এই এক পয়সার খেলনা,

যা ফাঁপা শোনায় আর শুনে মনে হয় নকল

সঙ্গীতকে হয়ে উঠতে দাও, অনেক বেশি করে আর সবসময় !

তোমার কবিতা হয়ে উঠুক চলমান জিনিস

যাকে অনুভব করে মনে হবে তা বদলে যাওয়া আত্মা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে,

অন্য আকাশ থেকে অন্য প্রেমের দিকে ।

তোমার কবিতাকে আনন্দময় ঘটনা হয়ে উঠতে দাও,

অস্হির ভোরের বাতাসের মাঝে,

যা পুদিনা আর থাইমলতার সুগন্ধ নিয়ে উড়ে বেড়ায়…

আর বাদবাকি সমস্তই সাহিত্য ।

          ফ্রান্সে, রোমান্টিসিজমের পর, তখন রোমান্টিসিজম বলতে যা বোঝাতো, আর পারনাসিয়দের দ্ব্যর্থহীন, ধ্রুপদি, অতিরিক্ত যত্নবান,  চিত্তাকর্ষকভাবে মোহনীয় কবিতার যুগের পর, সমাজ যখন কলকারাখানার আধুনিকতাবাদী সমাজে অনিশ্চিত জীবনযাপনের মুখোমুখি হওয়া আরম্ভ করল, গ্রাম থেকে দলে-দলে পরিবার শহরে অনিশ্চিত জীবনধারায় বসবাস করতে আরম্ভ করল,তখন পল ভেরলেনের মতন কবিরা কবিতায় অনিশ্চয়তার ও অনির্ণেয়তার প্রয়োজন অনুভব করলেন । পল ভেরলেনের ‘আর্ট পোয়েটিক’ কবিতাটি বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার উপস্হিতিকে কবিতায় আনতে চেয়েছে । তিনি অনুভব করলেন যে মানুষ চায় না  তাকে সীমা দিয়ে বেঁধে রাখা হোক, সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায় । নিজের বিবাহিত জীবন এবং পায়ুকামীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও কারাগারের জীবন থেকে তেমনটাই তাঁর মনে হয়ে থাকবে । ১৮৭৪ সালে যখন তিনি বললেন, ‘প্রথম এবং সর্বাগ্রে সঙ্গীত’, তখন ফরাসি কবিতায় নতুন কিছুর কথা বললেন তিনি । ফরাসি কবিতা চিরকালই সঙ্গীতময় ছিল, কিন্তু ভেরলেনের আগে কেউ বলেননি যে সঙ্গীতই কবিতায় মূল ব্যাপার । তার আগে তো ছিলই উপলবব্ধির গভীরতা, দৃষ্টিলব্ধ অবধারণা, বাচনিক নমনীয়তা ও পারিপাট্য । ভেরলেন সঙ্গীতকে কবিতায় গৌরবান্বিত করলেন । কবিতায় সঙ্গীত অদেখা বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ হবার উপায় বাতলায় এবং যে বাস্তবতা স্পষ্টভাবে প্রভাবান্বিত করে তাকে কবিতার সিংহাসনে বসায় ।

চার

          পল ভেরলেন আদেনেস থেকে জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে সতেরো বছরের এক কবিযশোপ্রার্থীর চিঠি আর চিঠির সঙ্গে তার লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন,  আর তাকে গাড়িভাড়া পাঠিয়ে বললেন প্যারিসে চলে আসতে । ১৮৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শার্লভিল থেকে প্যারিস পৌঁছোলেন র‌্যাঁবো, সঙ্গে নিজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে, যার মধ্যে একটি কবিতার শিরোনাম ছিল, ‘দি ড্রাঙ্কেন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ । স্টেশনে কেউ ছিল না তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য। ভেরলেন, তাঁর বন্ধু শার্ল গ্রস্ত-এর সঙ্গে গার দু নর্দ আর গার্দ দ্যলেস্ত-এর মাঝে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তরুণ অতিথির জন্য । শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মমার্ততে মাতিলদের বাবা-মায়ের বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন ; পল ভেরলেন বিয়ের পর শশুরবাড়িতে থাকতেন । পথে তাঁরা খুঁজে পেলেন রোদে পোড়া গম্ভীর-মুখ, নীল চোখ, তরুণটিকে, যে, তাঁদের সঙ্গে আরদেনেসের বাচনভঙ্গীতে হ্যাঁ-হুঁ করে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে কথা বলল ।   

          বারো বছর পরে তাঁর স্মৃতিচারণে ভেরলেন লিখেছেন যে, “তরুণটি ছিল দীর্ঘ, শক্ত কাঠামোর, খেলোয়াড়দের মতো আদরা, নিখুঁত ডিম্বাকার মুখ, যেন নির্বাসন থেকে ফেরা এক দেবদূত ; দেহের শক্ত কাঠামোর ওপরে শিশুসূলভ গালফোলা মুখ, হাবভাবে বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে দ্রুত বেড়ে-ওঠা জবুথবুপনা ।” ভেরলেনের স্ত্রী আর শাশুড়ি তরুণটিকে বাড়িতে নিয়ে আসা যে ভালো হয়নি তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কিন্তু তাড়াতে পারলেন না কেননা ভেরলেনের শশুর সেসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন । এক দিনেই তাঁরা টের পেলেন যে অতিথিটি চাষাড়ে, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে উলঙ্গ হয়ে রোদ পোয়ায়, যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল তাকে করে ফেলেছে নোংরা আর লণ্ডভণ্ড, যিশুর ছোটো ক্রস ভেঙে ফেলেছে, চুলে উকুন । ভেরলেন যা করতে চাইতেন অথচ করার সাহস পেতেন না, অতিথিকে সেসব করতে দেখে পুলক বোধ করছিলেন । 

          অতিথিকে বন্ধুদের আড্ডায় নিয়ে গেলেন ভেরলেন । লিয়ঁ ভালাদে নামে ভেরলেনের এক বন্ধু তাঁর আরেক বন্ধুকে লিখে জানিয়েছিলেন, “তুমি পল ভেরলেনের নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পেলে না, ভেরলেন যে তরুণটির জন দ্য ব্যাপটিস্ট ; বড়ো-বড়ো হাতের চেটো, বড়ো-বড়ো পা, মুখ যেন তেরো বছরের বাচ্চার, চোখ দুটো নীল, আর তরুণটি ভিতু মনে হলেও, মতামত অসামাজিক মনে হলো, কল্পনাশক্তি অজানা কুকর্মে ঠাশা, বন্ধুরা তো সবাই তাকে দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ আর আতঙ্কিত । তরুণটি যেন ডাক্তারদের মাঝে একজন শয়তান ।” প্রকাশক গঁকুরভাইদের একজন জানিয়েছেন যে ভেরলেনের অতিথির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সবচেয়ে বজ্জাত কোনো খুনির হাত । 

          মাতিলদের বাবার ফেরার আগের দিন ভেরলেনের অতিথিকে নিজের বাড়িতে কয়েকদিন রাখলেন শার্ল ক্রস ; তারপর পারনাসিয় কবি থিয়োদোর দ্যবাঁভিলের বাড়িতে চাকরানির ঘরে স্হান পেলেন । প্রথম রাতে জানলা দিয়ে নিজের ভিজে জামা-কাপড় রাস্তায় ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেললেন তরুণটি, চিনামাটির বাসন ভেঙে ফেললেন, বিছানায় কাদামাখা জুতো পরে শুলেন, আর গোপনে কয়েকটা আসবাব বেচে দিলেন । বাঁভিলও এক সপ্তাহ কাটতেই ভেরলেনকে বললেন নিজের অতিথিকে ফেরত নিয়ে যেতে । তরুণটির আচরণে একমাত্র ভেরলেনই আহ্লাদিত হচ্ছিলেন । মাতিলদেকে নিয়ে কবিতাগুলো লেখার পর ভেরলেন নতুন কবিতা লেখার সময় পাননি। তরুণটি তাঁকে ওসকাচ্ছিলেন অনভিজাতের মতো জীবন কাটাতে এবং মদে চুর হয়ে দ্রষ্টার মতো কবিতা লিখতে । তাছাড়া পল ভেরলেন পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পায়ুকামের আদর্শ সঙ্গী, যাকে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আরেক বন্ধুর বাড়িতে রক্ষিতার মতন লুকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। ভেরলেন তাঁর অভিজাত পোশাক ছেড়ে নামানো-টুপি আর গলায় মাফলার ধরেছিলেন, অতিথির জন্য টাকাকড়ি খরচ করছিলেন প্রচুর । তাঁদের পায়ুকামের সম্পর্ক যখন আর গোপন রইলো না তখন ভেরলেনের বন্ধুরা তাঁর পাশ থেকে সরে যেতে লাগলেন । দুজনে মিলে গুহ্যদ্বার নিয়ে একটা সনেট লিখলেন ( Sonnet du trou cul ), যার প্রথম আট লাইন ভেরলেনের এবং পরের ছয় লাইন র‌্যাঁবোর । কবিতাটা ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনেকে অনুবাদ করেছেন ; আমি পল শ্মিট-এর অনুবাদটা দিলুম এখানে :


Hidden and wrinkled like a budding violet

It breathes, gently worn out, in a tangled vine

(Still damp with love), on the soft incline

Of white buttocks to the rim of the pit.


Thin streams like rivers of milk ; innocent

Tears, shed beneath hot breath that drives them down

Across small clots of rich soil, reddish brown,

Where they lose themselves in the dark descent…


My mouth always dribbles with its coupling force;

My soul, jealous of the body's intercourse,

Makes it tearful, wild necessity.


Ecstatic olive branch, the flute one blows,

The tube where heavenly praline flows,

Promised Land in sticky femininity.

          র‌্যাঁবোকে একই সঙ্গে চরস আর আবসাঁথ খাইয়ে ভেরলেন অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে, যার অন্বেষণ করছিলেন তিনি, ‘ইন্দ্রিয়গুলোর অপরিমেয় ও নিয়মানুগ বিশৃঙ্খলা’ ঘটানোর জন্য । ২১ অক্টোবর ১৮৭১ ভেরলেনের ছেলের জন্ম হলো এবং সংবাদটিতে আনন্দিত হবার বদলে ক্রুদ্ধ হলেন তিনি । মাতিলদে জানিয়েছেন যে অক্টোবর ১৮৭১ থেকে জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভেরলেন তাঁকে মারধর করতেন আর খুন করার হুমকি দিতেন, একদিন সত্যিই গলা টিপে ধরেছিলেন, হাতখরচ না পেয়ে । স্বামীর দুর্ব্যাবহার আর মা-বাবার কাছে লুকোতে পারলেন না মাতিলদে, কেননা মাতিলদের দেহে আঘাতের চিহ্ণ আর স্বামীর কথা জিগ্যেস করলেই তাঁর কান্না থেকে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে চাষার ছেলেটা আসার পরে কি ঘটছে মেয়ের শোবার ঘরে । জামাইয়ের পায়ুকামের প্রতি আকর্ষণের খবরও তাঁদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল । ডাক্তার ডেকে মাতিলদেকে পরীক্ষা করিয়ে মেয়ে আর মেয়ের ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের পারিবারিক বাড়ি পেরিজিউতে ।

          স্ত্রী চলে যাবার পর ভেরলেন বিয়েটা বাঁচানোর চেষ্টায় র‌্যাঁবোকে বললেন বাড়ি ফিরে যেতে ; সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে দুজনে আবার একত্রিত হতে পারবেন । প্যারিসে আসার ছয় মাস পরে মার্চ ১৮৭২ সালে বাড়িমুখো হলেন র‌্যাঁবো ; তিনি জানতেন যে তাঁকে ছাড়া ভেরলেনের চলবে না । মাতিলদে ছেলেকে নিয়ে প্যারিসে ফিরলেন, তাঁর মনে হলো মিটমাট হয়ে গেছে, চাষার ছেলেটা বিদেয় হয়েছে । ভেরলেনও চাকরি খুঁজতে লাগলেন । কিন্তু গোপনে চিঠি লিখতে লাগলেন র‌্যাঁবোকে, জানতে চাইলেন কেমন করে কোথায় দুজনে মিলিত হবেন । পায়ুকামর নেশায় ভেরলেনের কবিতা থেকে মিনার্ভা আর ভিনাস বিদায় নিয়েছিলেন । র‌্যাঁবোর প্রভাবে ভেরলেন তাঁর অন্তরজগতে লুকিয়ে থাকা দানবটাকে বাইরে বের করে আনার সুযোগ পেয়ে গেলেন । ভেরলেনের দানবকে সহ্য করতে না পেরে ১৮৭২ সালে মেয়ের সঙ্গে আইনি বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন মাতিলদের বাবা, তখনও ডিভোর্স প্রচলিত হয়নি । ১৮৮৪ সালে ডিভোর্স আইনসঙ্গত হলে মাতিলদের সঙ্গে ভেরলেনের ডিভোর্স হয় । মাতিলদে আবার বিয়ে করেছিলেন এবং একষট্টি বছর বয়সে মারা যান ।

        ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে ভেরলেন আর র‌্যাঁবো লণ্ডন পৌঁছোলেন ; সেইসময়ে লণ্ডন ও বিশেষ করে সোহো ছিল ফরাসি কমিউনের পলাতক সদস্যদের লুকোবার পক্ষে ভালো জায়গা । কমিউনের প্রতি ভেরলেনের আগ্রহ থাকলেও র‌্যাঁবোর ছিল না । ভেরলেনকে তাঁর বুর্জোয়া মানসিক গঠন থেকে মুক্তি দেবার জন্য র‌্যাঁবো তাঁকে উৎসাহিত করলেন মুসেত এবং লেকঁত দ্যলিজের কবিতা পড়তে, ফরাসি কবিতার বারো মাত্রার ঐতিহ্য এবং ব্যালাডের আট মাত্রা অনুসরণ না করে দশ মাত্রার কবিতা লিখতে । র‌্যাঁবো তাঁকে পরামর্শ দিলেন কবিতা থেকে মানবিক কাহিনি, বাস্তববাদী ছবি আর ভাবপ্রবণ প্রতিকৃতি বাদ দিতে । পল ভেরলেনের মতে র‌্যাঁবোর ভালো লেগেছিল লণ্ডন ; তিনি ভেরলেনকে বলেছিলেন যে লণ্ডনের তুলনায় প্যারিসকে শহরতলি মনে হয়, লণ্ডনে রয়েছে কয়লা-চালিত ফ্যাক্ট্রি, টেমস নদীর ধারে জাহাজের ডক এবং সর্বোপরি একটি সাম্রাজ্যের রমরমা। ভেরলেন সেসমস্ত ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি কেবল কচি-তরুণ র‌্যাঁবোর সঙ্গে দৈহিক মিলনেই বেশি আনন্দ পেতেন, লণ্ডনে তাঁদের যথেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ ছিল না । র‌্যাঁবোর ‘নরকে এক ঋতু’ কবিতার ‘ফুলিশ ভার্জিন’ প্রসঙ্গ ভেরলেন সম্পর্কে । তাঁরা ডেরা নিয়েছিলেন কামডেনের গ্রেট কলেজ স্ট্রিটে ( এখন রয়াল কলেজ স্ট্রিট ); বাড়িটিতে একটা প্লেট লাগানো আছে যে তাঁরা দুজনে সেখানে ছিলেন । নিজেদের ‘উৎকট দম্পতি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন র‌্যাঁবো । লণ্ডন থেকে প্যারিসে এক বন্ধুকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আমি আর ফরাসি সংবাদপত্র পড়িনা ; পড়ে হবেই বা কি?” তাঁরা দুজনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রন্হাগারে যেতেন বটে কিন্তু পল ভেরলেন যেতেন শহরের শীত থেকে বাঁচার জন্য, যখন কিনা র‌্যাঁবো  যেতেন বিনে পয়সায় কাগজ-কলম-কালি পাওয়া যেতো বলে। বইপত্র পড়তেন । লণ্ডনের বাইরে বেড়াতে যেতেন দুজনে, ভেরলেন হ্যাম্পস্টেড হিথের কথা লিখেছেন, গ্রামাঞ্চল দেখার জন্য । র‌্যাঁবোকে ছাড়তে না পারার কারণ হিসাবে ভেরলেন লিখেছেন যে, এক ধরণের মিষ্টতা ঝলকাতো ওর নিষ্ঠুর ফিকে-নীল চোখে আর লালচে ঠোঁটের কটু ইশারায় । ইতিমধ্যে র‌্যাঁবো তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মত্ত নৌকো’র আঙ্গিক ছেড়ে নতুন ধরণের গদ্য-কবিতার দিকে ঝুঁকছিলেন, যার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ আর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর কবিতাগুলোতে ।

       লণ্ডন তাঁদের দুজনকেই অবাক করেছিল, আহ্লাদিত করেছিল । ভেরলেন বিস্মিত হয়েছিলেন দিগন্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া রেলপথ আর লোহার সেতু দেখে, আর পথে-পথে নির্দয়, বারফট্টাই-মারা জনগণকে দেখে । ভেরলেন লিখেছেন লণ্ডন ছিল অতিশালীন, কিন্তু অসচ্চরিত্র হবার সব রকমের সুযোগ ছিল অবারিত, আর প্রচুর খরচ সত্বেও, তাঁরা সদাসর্বদা থাকতেন এইল, জিন আর আবসাঁথে মাতাল । আবসাঁথের সবুজ পরী র‌্যাঁবোকে ডাক দিয়েছিল ‘স্বরবর্ণ’ নামের কবিতাটি লিখতে ।

স্বরবর্ণ

A কালো, E শাদা, I লাল,  U সবুজ, O নীল : স্বরবর্ণ

কোনো দিন আমি তোমার জন্মাবার কান্না নিয়ে কথা বলবো,

A, মাছিদের উজ্বল কালো মখমল জ্যাকেট

যারা নিষ্ঠুর দুর্গন্ধের চারিধারে ভন ভন করে,

ছায়ার গভীর খাত : E, কুয়াশার, তাঁবুগুলোর অকপটতা,

গর্বিত হিমবাহের, শ্বেত রাজাদের বর্শা, সুগন্ধলতার শিহরণ :

I, ময়ূরপঙ্খীবর্ণ, রক্তাক্ত লালা, নিঃসঙ্গের হাসি

যার ঠোঁটে ক্রোধ কিংবা অনুশোচনায় মাতাল :

U, তরঙ্গ, ভাইরিডিয়ান সমুদ্রের দিব্য কম্পন,

চারণভূমির শান্তি, গবাদিপশুতে ভরা, হলরেখার শান্তি  

কিমিতির চওড়া পড়ুয়া ভ্রুজোড়া দিয়ে বিরচিত :

O, চরম তূর্যনিনাদ, অদ্ভুত কর্কশ আওয়াজে ভরপুর,

জগত আর দেবদূতে রেখিত নৈঃশব্দ :

O, সমাপ্তি, মেয়েটির চোখের বেগুনি রশ্মি !


        র‌্যাঁবো খ্রিসমাসের জন্য বাড়ি ফিরলেও ভেরলেন ফিরতেন না ;র‌্যাঁবোর সমস্যা ছিল মা সবসময় বলতেন একটা চাকরি খুঁজে জীবনে স্হির হতে । ভেরলেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সংসারের বাঁধন থেকে, দায়িত্ব থেকে, এবং পাপবোধে ভুগে কাঁদতেন মাঝেমধ্যে ; তাঁর কাছে র‌্যাঁবো ছিলেন ‘দীপ্তিময় পাপ’ আর র‌্যাঁবোর কাছে ভেরলেন ছিল ‘ক্ষুদে প্রিয়তমা’ । ইংরেজি শব্দের তালিকা তৈরি করেছিলেন এবং লণ্ডনে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করেছিলেন ভেরলেন। ফ্রান্সের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে পল ভেরলেনের ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছিল। তাঁর ভবিষ্যতের জীবনীকার এদমন্দ লেপেলেতিয়েকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যেই একটা বড়ো সংস্হায় চাকরি পাবো, যেখানে প্রচুর রোজগার করা যাবে, ইতিমধ্যে আমি কয়েকটা আমেরিকান সংবাদপত্রের জন্য কাজ করছি যারা ভালো পয়সাকড়ি দ্যায় ।” লেপেলেতিয়ে তার কোনো প্রমাণ পাননি, এবং সবই ভেরলেনের বানানো, ফরাসি কবিদের ঈর্শ্বান্বিত করার জন্য । দুজন ভবঘুরে লণ্ডনের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন কাজের জন্য কিন্তু কারোর সাড়া তাঁরা পাননি ।    লেপেলেতিয়ে একটা কাগজের বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পেরেছিলেন, সম্ভবত র‌্যাঁবোর তৈরি খসড়া :

এক ফরাসি ভদ্রলোক ( ২৫ ), অভিজাত সমাজে যাঁর ভালো যোগাযোগ আছে, উচ্চশিক্ষিত, ফরাসি ডিপ্লোমাধারী, ইংরেজিতে সড়গড়, এবং বিপুল সাধারণ জ্ঞানের মানুষ, ব্যক্তিগত সচিব, পর্যটনের সঙ্গী কিংবা গৃহশিক্ষকের চাকরি খুঁজছেন । সম্ভ্রান্তদের সুপারিশ আছে । ঠিকানা : ২৫ ল্যানঘাম স্ট্রিট ।

          র‌্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর ‘ভবঘুরে’ কবিতাটি ( ১৮ নং ইল্যুমিনেশান ) তাঁদের দুজনের সেই সময়টিকে ধরে রেখেছে :

সমব্যথী ভাই ! ওর কাছে আমার কোনও নৃশংস নিশিপালন আছে ! ‘আমি এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টাকে দখল করে নিতে বিফল হয়েছিলুম । আমি ওর অকর্মণ্যতা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম । যদি আমাদের নির্বাসনে যেতে হয়, কেনা-গোলমী করতে হয়, তা হবে আমার দোষ।’ অদ্ভুত দুর্ভাগ্য আর বোকামির জন্য ও আমার প্রশংসা করেছিল, আর তার সঙ্গে জুড়েছিল অশান্তিকর কারণ ।

এই শয়তান পণ্ডিতকে আমি বিদ্রুপ করে উত্তর দিয়েছি, আর জানালার কাছে গিয়ে তা শেষ করেছি । বিরল সঙ্গীতরেখার চালচলনের অপর পারের চারণভূমিতে আমি ভবিষ্যতের রাতের বিলাসের মায়াপুরুষ গড়েছি ।

এই অস্পষ্ট স্বাস্হবিধিসন্মত চিত্তবিক্ষেপের পর, আমি খড়ের মাদুরের ওপরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তুম । এবং, বলতে গেলে প্রতি রাতে, যেই আমি ঘুমিয়ে পড়তুম, বেচারা ভাইটি উঠে পড়তো, মুখে দুর্গন্ধ, চোখে দেখতে পাচ্ছে না -- যেমন ও নিজের সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতো -- আর নিজের নির্বোধ কান্নার স্বপ্নে বিভোর আমাকে ঘরের ভেতরে টানাটানি করতো !

বাস্তবিক, সত্যি বলতে কি, আমি ওকে ওর সূর্যসন্তানের প্রাগৈতিহাসিক স্হতিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলুম -- আর আমরা ঘুরে বেড়ালুম, গুহার মদে ভরণপোষণ করে, আর পথের বিসকিট খেয়ে, আমি পরিসর আর ফরমুলা খুঁজে পাবার জন্যে অধৈর্য ।


          

          তাঁদের দুজনের ঝগড়া গ্রেট কলেজ স্ট্রিটেই আরম্ভ হয়েছিল । তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল । র‌্যাঁবো মাঝে একদিন ছুরি দিয়ে ভেরলেনের উরুতে আঘাত করেছিলেন । প্রেমিকের আঘাতের আদর বলে মেনে নিয়ে কাউকে জানাননি ভেরলেন । এই বিষয়ে ভেরলেন লিখেছেন, “আমি বাড়ি ফেরার সময়ে দেখলুম জানলা দিয়ে র‌্যাঁবো আমায় দেখছে । অকারেণেও আমাকে দেখে অপমানজনক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে লাগলো। যাহোক আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠলুম আর ঘরে ঢুকলুম । ‘তোমার কি কোনো ধারণা আছে এক হাতে একবোতল তেল আর অন্য হাতে একটা মাছ ঝুলিয়ে কেমন দেখাচ্ছিল তোমায় ?’ বলল র‌্যাঁবো । আমি তার জবাবে বললুম, আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাকে মোটেই উপহাসাস্পদ দেখায়নি ।’  ভেরলেন মাছটা দিয়ে র‌্যাঁবোর  মুখে সপাটে মারলেন আর জানালেন যে তিনি আত্মহত্যা করে নেবেন । ভেরলেন চটে গিয়ে জাহাজ ধরে সোজা চলে গেলেন বেলজিয়াম, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাবার উদ্দেশে । সেখানে মাতিলদে ছিলেন ।  

         র‌্যাঁবো কিছুক্ষণ পরেই ডকে পৌঁছে টের পেলেন যে ভেরলেন, তাঁর ‘বুড়ি শূকরী’ , সত্যিই চলে গেছেন । নিষ্কপর্দক র‌্যাঁবোকে সাহায্য করার কেউ ছিল না, আর যারা ছিল তারা দুজনের দৈহিক সম্পর্ক জানতে পেরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল ।  র‌্যাঁবো ভেরলেনকে চিঠি দিলেন :


তুমি কি মনে করো যে আমার বদলে অন্য লোকেদের সঙ্গে থাকলে তুমি আনন্দে থাকবে ? ভেবে দ্যাখো ! নিশ্চয়ই না ! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে ভবিষ্যতে আমি তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব । আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসি, আর তুমি যদি ফিরতে না চাও, কিংবা আমি তোমার কাছে যাই তা না চাও, তুমি একটা অপরাধ করছ, আর তার জন্য তুমি সমস্ত স্বাধীনতা হারিয়ে বহুকাল আফশোষ করবে, আর এতো ভয়ঙ্কর দুঃখদুর্দশায় ভুগবে যার অভিজ্ঞতা তোমার কখনও হয়নি ।


          ১৮৭৩ সালের ৮ জুলাই র‌্যাঁবোকে টেলিগ্রাম করলেন ভেরলেন ব্রুসেলসের হোটেল লিজে পৌঁছোতে । ভেরলেনের জামাকাপড় বেচে র‌্যাঁবো পৌঁছোলেন বেলজিয়ামের হোটেলে যেখানে ভেরলেন ছিলেন । দুজনের মনের মিল হল না, টানা কথা কাটাকাটি চলল । ভেরলেন একের পর এক আবসাঁথের বোতল খালি করে মাতাল হয়ে থাকতে চাইলেন । ১০ জুলাই তিনি একটা রিভলভার আর গুলি কিনলেন, আত্মহত্যা করবেন ভেবে । চারটে নাগাদ মাতাল অবস্হায় দুটো গুলি চালালেন র‌্যাঁবোকে লক্ষ করে । একটা গুলি লক্ষভ্রষ্ট হল, অন্যটা লাগল র‌্যাঁবোর কনুইতে । আঘাতকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে সঁ-জাঁ হাসপাতালে ড্রেসিং করিয়ে ব্রুসেলস ছাড়ার কথা ভাবলেন র‌্যাঁবো । সন্ধ্যা আটটা নাগাদ র‌্যাঁবোকে গারে দু মিদি রেলস্টেশনে ছেড়ে দেবার জন্য ভেরলেন আর ভেরলেনের মা গেলেন । আদালতে র‌্যাঁবোর সাক্ষ্য অনুযায়ী ভেরলেন পাগলের মতো আচরণ করছিলেন আর তাঁর পকেটে পিস্তলও ছিল । র‌্যাঁবো পুলিশের একজন টহলদারকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললেন তাঁকে ভেরলেনের থেকে বাঁচাতে । ভেরলেন গ্রেপ্তার হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠল, আদালতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে উকিল আর ডাক্তারদের প্রশ্নের মুখে পড়লেন ভেরলেন । 

          ১৭ জুলাই র‌্যাঁবোর বুলেট বের করার পর তিনি নালিশ তুলে নিলেন । পুলিশকে দেয়া বয়ানে র‌্যাঁবো লিখেছিলেন যে, গুলি চালিয়েই ভেরলেন তাঁর অপরাধের জন্য তক্ষুনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন । পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন তাঁর কপাল লক্ষ করে গুলি চালাতে। তাঁর আচরণ ছিল গভীর অনুতাপের । ভেরলেনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ তুলে নিয়ে কেবল আঘাত করার অভিযোগ বজায় রইলো । তাঁদের পরস্পরের পায়ুকাম নিয়ে আদালতে অপমানজনক কথাবার্তা হলেও তাকে অপরাধ বলে মনে করা হয়নি এবং পুলিশ আরোপ করেনি । ৮ই আগস্ট ১৮৭৩ ভেরলেনের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হল ।

          র‌্যাঁবো শার্লভিল ফিরে গিয়ে ‘নরকে এক ঋতু’ লেখা শেষ করলেন । তাতে ভেরলেনকে তিনি ‘উন্মাদিনী ভার্জিন’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, আর নিজেকে ‘নারকীয় স্বামী’ হিসাবে আর তাঁদের একসঙ্গে বসবাসকে বলেছেন ‘গার্হস্হ প্রহসন’। ১৮৭৪ সালে র‌্যাঁবো ফিরেছিলেন লণ্ডনে, কবি জারমেইন নোভোর সঙ্গে, তিন মাস ছিলেন একসঙ্গে । এই সময়ে তিনি ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর গদ্য-কবিতাগুলো লেখা শেষ করেন । কিন্তু পায়ুকামের নায়ক-নায়িকা বা আদম-ইভের কাহিনি এখানেই ফুরোয়নি । জেল থেকে র‌্যাঁবোকে চিঠি লিখতেন আর নিজের নতুন লেখা কবিতা পাঠাতেন, যেগুলো পড়ে র‌্যাঁবো মোটেই উৎসাহিত হতেন না । র‌্যাঁবো তখন কবিতা ও সাহিত্যজগত সম্পর্কে উদাসীন এবং নতুন জীবনের সন্ধান করেছেন, বাবার মতো উধাও হয়ে যেতে চাইছেন । পরস্পরের দৈহিক ভালোবাসার বদলে যিশুখ্রিস্টকে ভালোবাসার কথা বলছেন তখন ভেরলেন । র‌্যাঁবো ঠাট্টা করে তাঁকে লিখলেন যে ‘লয়োলা’ স্টুটগার্টে এলে দেখা হবে । লয়োলা ছিলেন এক যিশুভক্ত পাদ্রি ।

        পরস্পরের সাক্ষাতের সেই মুহূর্তটা এলো এবং কমেডি ছাপিয়ে গেল ট্যাজেডিকে । ভেরলেন গোঁ ধরলেন র‌্যাঁবোকে দীক্ষিত করার জন্য, একটা শুঁড়িখানায় দুজনে একত্রিত হয়ে । ভেরলেন আর র‌্যাঁবো দুজনেই মাত্রাহীন মদ টেনে মাতাল হলেন এবং আবার কথা কাটাকাটি আরম্ভ হল । শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে দুই বিখ্যাত কবির মধ্যে হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হল। র‌্যাঁবোর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব ছিল ভেরলেনের পক্ষে । মার খেয়ে মাতাল ভেরলেন, রক্তাক্ত, পড়ে রইলেন পথের ধারে ।

           সাত এম-এম ছয়গুলির পিস্তলটা ক্রিস্টির নিলামে  কেউ ষাট হাজার ডলারে সম্প্রতি কিনে নিয়েছেন ; তার আগে পিস্তলটা ছয়বার নিলাম হয়েছিল । মায়ের দেয়া টাকায় ‘নরকে এক ঋতু’ ছাপিয়ে, মাকে এক কপি দিয়ে, কবিতার প্রতি র‌্যাঁবোর আকর্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল ; ইল্যুমিনেশান্স’ আর ছাপাবার প্রয়োজন বোধ করেননি, যা করার কোরো বলে পাণ্ডুলিপি ভেরলেনকে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন আফ্রিকায়, ভিন্ন জীবনের সন্ধানে । ভেরলেন কবিতাগুলো মে-জুন ১৮৮৬-এ  ‘প্যারিস লিটেরারি রিভিউতে’ প্রথমে প্রকাশ করার জন্য দেন । তারপর গ্রন্হাকারে প্রকাশের ব্যবস্হা করেন ১৮৮৬ সালের অক্টোবরে । 

 আমি যে পথিক, এসো পথে নামি | arts.bdnews24.com


-------------------------------------------------------------XXXXXXXXXXX-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন